'লাউয়াছড়া চিত্রিত আচিল ব্যাঙ'
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, শ্রীমঙ্গল:
হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন পাখির বিষ্ঠা! চোখ এড়িয়ে যাওয়া ছোট্ট একটি জিনিস পড়ে আছে মাটি কিংবা লতাপাতার ওপর। বাস্তবে এটি ক্ষুদ্র মেরুদণ্ডী প্রাণী। বরাবরই ওরা অদেখা বস্তুর মতো নীরবে মিশে থাকে প্রকৃতিতে। ক্ষুদ্রতম বলে স্বাভাবিকভাবে নজরেও আসে না। অণুবীক্ষণের চোখ নিয়ে খুঁজতে গেলেই ধরা পড়ে উপস্থিতিটা। তাও সব সময় না, কখনো-সখনো। আলোচিত প্রাণীটি বিরল প্রজাতির ক্ষুদ্রাকৃতির ব্যাঙ। নাম ‘চিত্রিত আঁচিল ব্যাঙ’ বা ‘শৈবাল আঁচিল ব্যাঙ’ খুবই বিরল প্রজাতির এই ব্যাঙের ইংরেজি নাম Pied warty frog এবং বৈজ্ঞানিক নাম Theloderma Asperum। এই প্রজাতির ব্যাঙ দৈর্ঘ্যে মাত্র ১৬ মিলিমিটার পর্যন্ত থাকে। আমাদের বুড়ো আঙুলের নখের সমান প্রায়। শরীরজুড়ে রয়েছে সাদা ও কালো রঙের বাহার। চোখের অংশ খানিকটা লাল। বন্য প্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী তানিয়া খান বাংলাদেশে প্রথম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে এই ব্যাঙের সন্ধান পান। এ প্রসঙ্গে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা হচ্ছে এক প্রকারের ক্ষুদ্র সৌন্দর্য।
নিজ চোখে না দেখলে এর সৌন্দর্য বর্ণনায় বোঝানো কঠিন। চিত্রিত আঁচিল ব্যাঙটি বাংলাদেশে নতুন আবিষ্কার।’ তিনি জানান, ২০১২ সালের ১৭ অক্টোবর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে তিনি এই ব্যাঙ প্রথমবারের মতো খুঁজে পান। দ্বিতীয়বার দেখতে পান ওই বছরেরই ২১ অক্টোবর। এর পর অনেকবার লাউয়াছড়ায় কাজ করতে গিয়েও ওই ব্যাঙ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই গবেষক বলেন, ‘ব্যাঙটির সন্ধান পাওয়ার পর এর ছবি তুলে দুবাইয়ে বসবাসরত বাংলাদেশের প্রখ্যাত বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. রেজা খানকে ই-মেইলে পাঠিয়ে দিই। তিনি ছবিগুলো দেখে নিশ্চিত হয়ে আমাকে জানান, এটি চিত্রিত আঁচিল ব্যাঙ। ১৯৭৭ সালে সম্ভবত তিনি এই ব্যাঙটিকে লাউয়াছড়াতেই দেখেছিলেন। কিন্তু তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আসমত ও মান্নান নামে অন্য দুই প্রাণী গবেষক ২০০৭ সালে এই প্রজাতির ব্যাঙের নামকরণ করেন আঁচিলা গেছো ব্যাঙ।’ তানিয়া আরো বলেন, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ বা আইইউসিএনের তথ্যানুসারে অবশ্য চিত্রিত আঁচিল ব্যাঙ বিপন্ন তালিকাভুক্ত নয়। তবে নানাভাবে পরিবেশ দূষণের কারণে এদের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। এরা দিনের আলোতে লুকিয়ে থাকে। রাতে খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে শুধুই ছোট ছোট পোকা-মাকড়। তানিয়ার দেওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে মোট ৩৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে; যার সবই ব্যাঙ। যত প্রজাতির ব্যাঙ বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যায় তার মধ্যে এই চিত্রিত আঁচিল ব্যাঙ সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্রাকৃতির। ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, ভারতের মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশের পাহাড়-অরণ্যে এদের দেখা মেলে। পানি দূষণ, চাষাবাদের জন্য ভূমির ব্যবহার, নগরায়ণ, ভূমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সর্বোপরি প্রাকৃতিক নানা প্রতিকূলতা যে হারে বাড়ছে তাতে নিশ্চিত করেই বলা যায়, অদূর ভবিষ্যতে এই প্রাণিটি অস্তিত্ব সংকটে পড়তে যাচ্ছে। লাউয়াছড়ার জীববৈচিত্র্য প্রসঙ্গে তানিয়া বলেন, ‘আমার দৃষ্টিতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এখনো প্রকৃতির এক রহস্যময় খনি। দরকার শুধু উদ্যানটির প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ, পরিচর্যা ও পর্যটকদের বিচরণক্ষেত্র নির্ধারণ করে দেওয়া। তা হলেই লাউয়াছড়া জীববৈচিত্র্যের মহাসমন্বয় কেন্দ্র হিসেবে পরিপূর্ণতা লাভ করবে।’ বন কর্মকর্তা মনির আহমেদ খান বলেন, ব্যাঙের প্রজনন মৌসুম বর্ষাকাল। তবে সেটি নির্ভর করে বৃষ্টি-বাদলের ওপর। এপ্রিলের প্রারম্ভিক বর্ষা থেকেই এদের প্রজননের শুরু। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনে প্রকৃতিও এখন আর নিয়ম ধরে চলে না। ফলে ব্যাঙের প্রজনন বাধাগ্রস্ত ঝুঁকিটা ক্রমেই বাড়ছে।