বাঘবন্দি

২৬ রমজান । বিকেল বেলা হটাৎ করে বন্ধু হাসান মুরশেদের ফোন । মুরশেদ জানালো, হরিপুরের কাছে একটা বাঘ ধরা পরেছে । লোকজন বাঘকে বন্দী করে নানা ধরনের তামাশার আয়োজন করছে । আমি যেন বাঘটা উদ্ধারের জন্য চেষ্টা করি । মুরশেদের কাছে বাঘবন্দির খবর শুনে সিলেটের ডিএফও সাহেবকে ফোনে কয়েকবার চেষ্টা করলাম । মোবাইল ধরছেন না । ধরার কথাও নয় । আজ শবেকদর । সারা বছরের দুর্নীতির জন্য আজ মাফ চাইবেন । শবেকদর-শবেবরাত এইসব বিশেষ দিন কিছু কিছু মানুষের জন্য বিশেষ মর্তবার । বন বিভাগের ল্যান্ড ফোনেও চেষ্টা করলাম । কেউ ফোন ওঠায় না ।

 গ্রিন এক্সপ্লোরের অনিমেষের কাছে ফোন করে ডিএফও ওয়াইল্ড লাইফের নাম্বার নিলাম । ভদ্রলোকের বিভাগীয় অফিস মৌলভীবাজারে । উনাকে ফোন দিতেই ফোন ওঠালেন । বললাম, কিছু সময় আগে সিলেটের হরিপুরের কাছে ‘পাখিটেকি’ নামক স্থানে স্থানীয় লোকজন ফাঁদ পেতে একটি বাঘ ধরেছে । লোকজন স্বভাব অনুযায়ী বাঘটিকে খুঁচিয়ে আহত করেছে, বাঘটিকে মেরে ফেলতে পারে । ডিএফও ওয়াইল্ড লাইফ মাহবুব সাহেব বললেন, আমার একজন রেঞ্জার আপনাকে ফোন করবেন; তাকে ঠিকানা দিলেই হবে । আধঘণ্টা অপেক্ষার পরেও রেঞ্জারের ফোন পেলামনা ।

ট্রাকে করে বাঘ নিয়ে আসা হয় খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে ।mechobagh

 ব্যক্তিগত ভাবে তাই ফোন দিলাম সিলেটের পুলিশ সুপার মিনা ভাইকে । তিনি ঘটনা শুনে ওসি জৈন্তাপুরকে বাঘটি উদ্ধার করতে নির্দেশ দিলেন । আরও আধ ঘণ্টা পর ওয়াইল্ড লাইফের রেঞ্জার সাহেব ফোন দিয়ে ঘটনা জানতে চাইলেন । আমি জানালাম ইতিমধ্যে, পুলিশ বাঘটি উদ্ধারে চলে গেছে । উনি তখন কাতর ভাবে বললেন, শবে কদরের রাতে আমার পক্ষে মৌলভীবাজার থেকে এসে বাঘ উদ্ধার খুব কঠিন হবে । যেহেতু পুলিশ উদ্ধার করবে, তাই উনি আমাকে বললেন আমি যেন উনাদের পক্ষে যে কোন বনে বাঘটি অবমুক্ত করে দেই । আমি বুঝলাম, উনারা ওয়াইল্ড লাইফে চাকরি করেন, কিন্তু  ওয়াইল্ড লাইফের প্রতি মমত্ববোধ নেই । তাঁর অনাগ্রহ দেখে আমি আর কিছু বললাম না । ইফতারের সময় হয়ে যায় ইতিমধ্যে । ইফতার শেষে বাঘ উদ্ধারের অগ্রগতি জানতে ওসি, জৈন্তাপুরকে দুইবার ফোন দিলাম । উনি ফোন ধরলেন না । এবার এসপি সাহেবকে ফোন দিলাম । উনি ফোন না ধরে সম্ভবত ওসি সাহেবকে ফোন দিলেন এবং আমাকে অগ্রগতি জানাতে বললেন । ওসি সাহেব ফোন দিয়ে আমায় বললেন, লোক গেছে এখনো আসেনি । আমি জানতে চাইলাম বাঘ কি আসলেই ধরা পরছে ? উনি বললেন, ধরা পরছে, আহত । উনি জানতে চাইলেন এসপি সাহেবকে বাঘের খবর কি আমি জানিয়েছি ? এই খবর বন বিভাগকে জানানো উচিৎ ছিল, এটাও বললেন তিনি । উনার কথার সুরে বুঝতে পারলাম আজাইরা একটা প্যাচালে সময় নষ্ট করতে হচ্ছে বলে খুব বিরক্ত তিনি । ঈদের আগে আমদানি ছাড়া কাজে ভালো না লাগার কথা ।

 আমি আহত বাঘ উদ্ধারের অগ্রগতি না যেনেই শবেকদরের পুণ্য অর্জনের খাস দিলে দরগা মসজিদ অভিমুখে রওয়ানা হলাম । তারাবীর প্রতি দুই রাকাত নামাজ অন্তে ফোন চেক করি । দেখি, ওসি সাহেবের কোন ফোন আসেনি । নামাজের প্রায় শেষ পর্যায় ওসি সাহেবের ফোন পেলাম । উনি জানালেন বাঘ উদ্ধার করে উনাদের লোক বাঘটিকে বনবিভাগের সারিঘাট বিট অফিসে জমা দিয়েছে । এ কথা বলেই ফোন রেখে দিলেন তিনি । আমি এই সংবাদে তৃপ্ত হলাম না । আমার প্রয়োজন সারী বিট অফিসারের নাম্বার । ওয়াইল্ড লাইফের সেই রেঞ্জার সাহেবকে এবার ফোন দিলাম । উনার এবাদত শেষ হয়নি, তাই ফোন ধরলেন না । ওসি, জৈন্তাপুরকে আবার ফোন দিলাম, উনিও ফোন ধরলেন না । হটাৎ মনে হ’ল সারী নদী বাঁচাও আন্দোলনের আব্দুল হাই-এর কথা । হাই ভাই ঘটনা শুনে, সারী বিট অফিসারের নাম্বারও দিলেন এবং নিজেও কথা বললেন । নাম্বার পেয়ে আমি ফোন দিলাম বিট কর্মকর্তাকে ।

সারীর বিট অফিসার আতাউর রহমান জানালেন বাঘ পেয়েছেন । বাঘটি পরদিন সকাল ৯টায় খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করবেন । ভালো কথা । কিন্তু রোজা মাসে তাও আবার শবেকদরের রাত্রির পর ! আমার বিশ্বাস হল’না । আমি বললাম, এতো সকালে না ছেড়ে আপনি বেলা ১২টা বা সাড়ে বারোটার দিকে ছাড়েন । উনি দেখলাম এই কথায় বিরক্ত । তাই উপায় না দেখে, ফট করে বলে বসলাম, এই বাঘ অবমুক্ত করতে উপস্থিত থাকবেন সিলেটের অতিরিক্ত ডিআইজি সাহেব । তাছাড়া অনেক সাংবাদিকও থাকবে । এ কথা শুনে উনি বললেন, ডিআইজি সাহেবই যখন ছাড়বেন তখন থানার লোক বাঘটা আমার কাছে কেন নিয়ে এলো ? তারা নিজেরাই সকালে খাদিম নিয়ে যেতে পারতো । আমি বললাম, পুলিশ উদ্ধার করেছে এটাই কি যথেষ্ট নয় ? এটা আপনাদের সম্পদ, এখন এটা আপনারা বাঁচাবেন । তখন বিট কর্মকর্তা বললেন, ভাই এটা আমাদের দায়িত্ব নয়, এটা আলাদা বিভাগের । সেই বিভাগের নাম ওয়াইল্ড লাইফ । এমন মেজাজ খারাপ হল । দিলাম ভালো করে ঝাড়ি । এবার সুর নরম করে বললেন, ভাই কি করবো বলেন, এই যে বাঘ উদ্ধার করে এখন এটা খাদিম অবমুক্ত করবো তাতে আমার যে খরচ হবে তার পুরোটাই আমার পকেট থেকে যাবে । এমন কি পুলিশ মিনি ট্রাকে করে বাঘটি নিয়ে এসে আমার কাছে এক হাজার টাকা খরচ বাবদ দাবি করে । শেষে পকেট থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে ওদের বিদায় করি । এখন কালকে যদি সারী থেকে এই বাঘ আবার খাদিম নগর নিয়ে যাই; তাতেও ট্রাক ভাড়া বাবদ আমার আরও তিন হাজার টাকা লাগবে । আমি বললাম তাহলে কি আপনি এটা খাদিম ছাড়বেন না ? উনি বললেন। না ছাড়বো কিন্তু বাঘটাকে এই খাঁচায় করে না এনে অন্যভাবে সিএনজিতে করে আনতাম । আমি যা বোঝার তা বুঝে গেলাম । এই কয়টা টাকা বাঁচানোর জন্য বাঘটাকে এরা নাও ছাড়তে পারে । আমি ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করলাম আপনি এইবার কষ্ট করে ট্রাকে করেই নিয়ে আসুন, আমি আপনার টাকার ব্যাবস্থা যেন হয় তা দেখবো ।

ডিআইজি সাহেব অবমুক্ত করবেন এটা কনফার্ম না করেই বলে ফেলেছি । তাই তারাবী নামাজ শেষে দরগাতেই সিলেটের অতিরিক্ত ডিআইজি সাখাওয়াত সাহেবকে পেয়ে গেলাম । উনাকে বলতেই উনি রাজি হলেন ।

পরদিন সকালে বেশ ক’জন সাংবাদিককে ফোন দিলাম । হাসান মুরশেদ সহ আরও দু-চারজন বন্ধু বান্ধবকেও জানালাম । কাউকে ফোনে পেলাম, কাউকে পেলাম না । বাঘ অবমুক্ত করতে খাদিমনগর গেলাম । একটা সিএনজি ভাড়া করলাম দুই/তিন ঘণ্টার জন্য । সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সঙ্গী প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক আনিস মাহমুদ, বাংলানিউজ২৪-এর শেখ নাসির ও এসএ টিভির শ্যমলানন্দ । প্রায় সাড়ে বারোটায় মিনি ট্রাকে করে বাঘটি নিয়ে সারী বিটের কর্মকর্তা আসলেন । বাঘটি দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায় । নির্মম ভাবে আহত করা হয়েছে বাঘটিকে । এই ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে বাঘ বা অন্য বন্যপ্রাণী ধরার জন্য । ক্ষুদার্ত বাঘটাকে দেখে পরিচর্যা করতে ইচ্ছে হল ।

অতিরিক্ত ডিআইজি সাহেব তখনো এসে পৌঁছাননি । উনাকে ফোনে অনুরোধ করলাম এক কেজি টাটকা গরুর মাংস কিনে আনতে । উনি কিনে আনলেন । বাঘটাকে মাংস খাওয়ানোর চেষ্টা করা হল । ছুঁয়েও দেখল না । মানুষের হাতে ধরা পরে নির্যাতিত হয়ে সম্ভবত প্রতিজ্ঞা করেছে বাকি জীবন নিরামিষ খাবে । মাংস খাওয়াতে না পেরে মনে হল সে খুব তৃষ্ণার্ত । তাই পানি খাওয়াতে শুরু করলাম । খুব আগ্রহ নিয়ে প্রায় দুই লিটার পানি খেল । ডিআইজি সাহেবকে সাথে নিয়ে পানি খাওয়ানোর পর আমরা খাঁচার মুখ খুলে দিলাম । বাঘটি ধীর লয়ে রাজকীয় ভাবে হেঁটে বাইরে এলো । কিছু দূর গিয়ে থামলো । ঘুরে আমাদের দেখলো এবং মনে হল আন্তরিক ভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছে ।

আব্দুল করিম কিম , সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সিলেট শাখা।

Related Articles

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics