বিপন্নের তালিকায় মথুরা
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
পাহাড়ি নির্জন উপত্যকায় ওদের বিচরণ। সারাক্ষণ ভয় আর লাজুকতায় জড়ানো। কোনো শব্দ বা কোনো মানুষের হঠাৎ উপস্থিতি টের পেলে নিমেষেই লুকিয়ে পড়ে বনের গহিনে। আর খোঁজ মেলা ভার। জনশূন্য বনের প্রাকৃতিক নিস্তব্ধতায় আপন মনে ঘুরে বেড়ানো পাখিটির নাম ‘মথুরা’ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ পাখিটি বিপদমুক্ত হলেও বাংলাদেশে এটি বিপন্নের তালিকায়। প্রায় দু’দশক আগে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে অবস্থিত চাম্পারায় চা বাগানে মথুরার প্রথম দেখা পাই। দেখতে অনেকটা বন মোরগের মতোই। বিভিন্ন চা বাগানের পাহাড়ি এলাকায় ভ্রমণের পথে সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়েও এদের অস্তিত্ব আর এখন সেভাবে চোখে পড়ছে না। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, বনভূমি ধ্বংস, শিকারির ফাঁদের মতো নানা প্রতিকূলতা ওদের বিপন্ন পাখির সারিতে ঠেলে দিয়েছে। এর মাঝে মথুরার টিকে থাকার স্বাভাবিক সংগ্রাম যেন জীববৈচিত্র্যেরই এক স্বতঃফূর্ত আন্দোলন। এ বিবেচনায় বলা যেতে পারে অরণ্যঘেরা কিছু কিছু তৃণভূমির উপর তাদের দলগত লাজুক কোমল স্পর্শ আজও প্রকৃতির নিজস্ব অধিকার ও সৌন্দর্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে গোপনে।
পাখি ও পরিবেশ বিষয়ক গবেষক সৌরভ মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্বে মথুরার ৯টি প্রজাতির উপস্থিতি থাকলেও আমাদের দেশে শুধুমাত্র একটি প্রজাতিই খুঁজে পাওয়া যায়। এরা অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির পাখি। এরা মানুষের আগমন বুঝতে পারা মাত্রই পালিয়ে যায়। মূলত এরা পারিবারিক ছোট দলেই বিচরণ করে থাকে। তবে জোড়ায় জোড়ায়ও সচরাচর এদের দেখা পাওয়া যায়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, রেমা-কলেঙ্গা, মাধবকুন্ডের বনাঞ্চলসহ চা বাগান এলাকায় এদের হঠাৎ হঠাৎ দেখা পাওয়া যায়। তবে সব চা বাগান এলাকায় এরা থাকে না। পাহাড়ি অঞ্চলঘেরা চা বাগানগুলোতেই এদের দেখা যায়। স্বভাবগত কারণেই তারা হঠাৎ লুকিয়ে যায় বলে পাহাড়ি অঞ্চলের কাছাকাছি থাকতে বেশি পছন্দ করে। খুব সকালে এবং সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে ওরা বেশি বিচরণ করে। আজ থেকে প্রায় বিশ-ত্রিশ বছর আগে এরা প্রচুর পরিমাণে ছিল। বনাঞ্চল উজার ও শিকার এদের বেঁচে থাকাকে হুমকি মুখে ঠেঁলে দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মথুরার শরীরের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬২ সেমি এবং লেজের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৩ সেমি। এদের ওজন প্রায় দেড় কেজি। বটফল, বীজ, পোকামাকড়, ছোট সাপ, গিরগিটি এদের খাবার। পাতলা ও ময়লা আবর্জনা দিয়ে বনের ঝোপের মধ্যে বাসা বাঁধে। মার্চ থেকে অক্টোবর এদের প্রজনন মৌসুম। ৬টি থেকে ৯টি ডিম পাড়ে। মেয়ে পাখি একাই ডিমে তা দিয়ে ২০-২১ দিনে ছানা ফোটায়।’
মথুরা দেখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মথুরার ছবি ক্যামেরায় ধারণ করার জন্য আমি সাত ঘন্টা গভীর ধৈর্য্য নিয়ে একটা জায়গায় বসেছিলাম। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু মথুরা আসছে না! তারপর সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহুর্তে ওরা এলো। আমি আগে থেকেই জানতাম যে ওরা ওখানে মাঝে মাঝে আসে। চা বাগানের পাহাড়ি বনভূমি ব্যতিত এর দেখাই পাওয়া যায় না। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে বনের পথে নীরবে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই হয়তো দেখা মেলে যায় তার। এদের দেখা পাওয়া আসলেই একটি দুর্লভ ঘটনা।’
মথুরা সংরক্ষণের বিষয়ে সৌরভ মাহমুদ বলেন, ‘চা বাগানের পাহাড়ি ঝোঁপ-ঝাড় ও জঙ্গলগুলোকে রক্ষা করতে হবে। ওই সব জঙ্গলগুলো কেটে রাবার, সেগুন প্রভৃতি গাছ রোপণ করা হলে মথুরা আর সেখানে টিকে থাকতে পারবে না। গণসচেতনতার মাধ্যমে এর শিকার রোধসহ প্রাকৃতিক চিরসবুজ বনকে টিকিয়ে রাখতে পারলেই মথুরাদের সংরক্ষণ করা অনেকটাই সহজ হবে। সুন্দর ও রাজকীয় স্বভাবের এ পাখিটিকে টিকিয়ে রাখা আমাদের সবার কর্তব্য।’
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সূত্রে জানা যায়, মথুরা বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। এর ইংরেজি নাম Kalij Pheasant এবং বৈজ্ঞানিক নাম Lophura leucomelanos। তবে কালা মথুরা, কালি মথুরা, কালি ময়ুর প্রভৃতি নামেও ডাকা হয় তাকে। চাকমা, খাসিয়া, মারমা ও ত্রিপুরা এই চার নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভাষায় একে বলা হয় যথাক্রমে সানগ্র“, খ্রুট, রই রাতা ও টকরু।ছেলে ও মেয়ে পাখির আকার ও রঙের ভিন্নতা রয়েছে। ছেলেপাখির পিঠ গাঢ় নীল ও কালোয় মেশানো। মাথার চূড়ার পালক খাড়া। মুখের চামড়া ও গলায় ঝুলন্ত উজ্জ্বল লাল লতিকা। দেহতলে কালো রঙের উপর বেগুনি চাকচিক্য। মেয়েপাখির দেহ বাদামি পালকের ধূসর প্রান্ত অনেকটা আঁইশের মত দেখতে। মাথার চূড়া, লেজের পালক ও গলা প্রায় বাদামি। কোমর ও পায়ের পালক ফিকে রঙের। ছেলে ও মেয়েপাখির ঠোঁটে রয়েছে সবুজ আভা এবং চোখ পিঙ্গল থেকে কমলা-বাদামি। সিলেট ও চট্টগ্রামের চিরসবুজ বনে এদের পাওয়া যায়। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে এদের বিচরণ রয়েছে।
লেখক : প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক এবং
দৈনিক কালের কণ্ঠের শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
সূত্র : ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠ