নাম তার ডোরাকাটা বাঘ
আ ন ম আমিনুর রহমান
ওকে প্রথম দেখেছিলাম রমনা উদ্যানে। তারপর বহুদিন পেরিয়েছে। এ বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে দেখলাম কাপ্তাইয়ে, অল্প সময়ের জন্য। ১৫ মার্চ সকালে পাখির খোঁজে হবিগঞ্জের কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে গিয়ে তার সঙ্গে আবার দেখা। ইদানীং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও দেখা যাচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত ওর ভালো ছবিটা কিন্তু তুললাম সেই রমনা পার্ক থেকেই গত ৫ এপ্রিল।
এতক্ষণ যার কথা বললাম, কে সে? সে ‘ডোরাকাটা বাঘ’ নাম শুনে নিশ্চয়ই একটু চমকে গেলেন! অবশ্য সুন্দরবনের মানুষখেকো ডোরাকাটা বাঘ হলে তো চমকাতেই হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ভয়ের কিছু নেই। কারণ, আমাদের বনের রাজা বাঘের ধারে-কাছের প্রাণীও নয় সে। বরং সে হলো মাঝারি থেকে বড় আকারের একটি দৃষ্টিনন্দন প্রজাপতি। চূড়া বাদে সামনের দুই ডানার ওপরের বাকি অংশ দেখতে আমাদের জাতীয় পশু বেঙ্গল টাইগারের মতো ডোরাকাটা বলেই এমন নাম। অনেকের কাছে ‘বাঘ’ বা ‘বাঘবাল্লা’ নামেও পরিচিত। ওকে রাজকীয় প্রজাপতি হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই ‘রাজা’ (Monarch) নামেও পরিচিত। ইংরেজিতে বলে Striped Tiger/Common Tiger/Indian Monarch। Danaidae (ডানাইডি) পরিবারে সদস্য এই ডোরাকাটা বাঘের বৈজ্ঞানিক নাম Danaus genutia genutia.
এরা পরিযায়ী স্বভাবের প্রজাপতি। সব অঞ্চলেই বাস করতে সক্ষম। তবে অতি বৃষ্টিপাতপ্রবণ এলাকায় বেশি দেখা যায়। সারা বছরই ঝোপ-জঙ্গল ও বাগানে ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়। সমুদ্রপৃষ্ঠের দুই হাজার ৫০০ মিটার উঁচুতেও দেখা মেলে। এরা ধীরগতির প্রজাপতি। তবে পরিযায়ী স্বভাবেরগুলো দ্রুতগতিতেও উড়তে পারে। হেমন্তে এরা সহজেই কানাডা থেকে মেক্সিকো পর্যন্ত পথও পাড়ি দিতে পারে।
প্রসারিত অবস্থায় এদের ডানার মাপ স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ৭ দশমিক ২ থেকে ১০ দশমিক শূন্য সেন্টিমিটার হয়। সাধারণত পুরুষটি স্ত্রীর চেয়ে কিছুটা বড়। সামনের ডানার ওপরের কোষগুলো গাঢ় কমলা-বাদামি। পেছনের ডানারগুলো হালকা কমলা-বাদামি। ডানার কালো ও স্পষ্ট শিরাগুলোই ডোরাকাটা দাগের সৃষ্টি করে। সামনের ডানার চূড়া কালো। নিচে তিনটি কমলা ও কতগুলো সাদা দাগ রয়েছে। এ ছাড়া পুরো ডানার প্রান্তজুড়ে রয়েছে কালো ডোরা, যার ওপর দুই সারি সাদা ফোঁটা। কালোর ওপর সাদা ফোঁটার এই কারুকাজ প্রজাপতিটির মাথা, বুক ও পেটেও দেখা যায়। দেহের নিচের অংশের রং ও কারুকাজ ওপরের অংশের মতোই, তবে হালকা। পেছনের ডানার নিচের দিকে সাদা-কালো ফোঁটা দেখে পুরুষ প্রজাপতি চেনা যায়। দেহ ও ডানার উজ্জ্বল কমলা ও কালো রং কিন্তু বেশ বিষাক্ত। এই রং দেখেই শত্রুরা এদের ধারেকাছে ঘেঁষতেও সাহস পায় না।
স্ত্রী প্রজাপতি নির্দিষ্ট গাছের পাতার নিচের প্রান্তে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা পাতাপ্রতি একটি। লম্বাটে ডিমগুলোতে কাঁটার মতো থাকে। এগুলোর রং ক্রিম-সাদা, যা পরে হালকা হলদে হয়ে যায়। ডিম ফুটে শূককীট বের হতে মাত্র চার দিন লাগে। শূককীট বের হয়ে প্রথমেই ডিমের খোসাটি খেয়ে ফেলে। এর পর থেকে পাতা খেয়েই বড় হয়। শূককীটের দেহে হলুদ, কালো ও সাদা ডোরা থাকে। মাথায় থাকে হলুদ ও কালো ডোরা। এগুলো ৫ সেন্টিমিটার লম্বা। শূককীট দুই সপ্তাহ পর মুককীটে পরিণত হয়। আর মুককীট অবস্থায় দুই সপ্তাহ থাকার পর একদিন সকালে খোলস কেটে পূর্ণবয়স্ক ডোরাকাটা বাঘ বের হয়ে আসে। এরা দুই থেকে আট সপ্তাহ পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
বাংলাদেশ ছাড়াও পুরো এশিয়া, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো এবং ক্যানারি দ্বীপে এদের দেখা মেলে।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো (০৭/০৫/২০১৩)