জলবায়ু প্রতিবেদন কি ভবিষ্যতের সতর্কবার্তা ???
তানভীর হোসেন
বিগত শতাব্দীতে বায়ুমন্ডল ও জলমন্ডল উত্তপ্ত হয়েছে, তুষার এবং বরফ গলেছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বেড়েছে। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সে সকল তথ্যের ভিত্তিতে অনাগত সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন মাত্রা নির্ধারন করেছেন যা বৈশ্বিক বৈজ্ঞানিক ঐক্যমতের উপর প্রতিষ্ঠিত।
ইন্টারগভারনমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ (IPCC) এই বিষয়ে কিছু ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করেছে। “ দশক থেকে সহস্রাব্দ ধরে জলবায়ুর অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে ”-উক্তিটি দিয়ে শুরু হওয়া প্রতিবেদনটির সারসংক্ষেপে বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন এবং ভবিষ্যত প্রভাব সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গত তিন দশকের প্রতি দশকেই পর্যায়ক্রমে পৃথিবী-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে যা ১৮৫০ সাল থেকে সময়ের যেকোনো দশকের চেয়ে বেশি। বায়ুমন্ডল ও সমুদ্রের অভ্যন্তরে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যেমন- ভূ-পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রার উপাত্তে দেখা যায়, ১৮৮০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১.৫° ফারেনহাইট(০.৮৫°সেলসিয়াস) পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে; যা উক্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের সহকারী পরিচালক, সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব বার্নের অধ্যাপক থমাস স্টকার প্রতিবেদন প্রকাশের প্রাক্কালে বলেন, “ জলবায়ু প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনটা এখন অনেক স্পষ্ট এবং এটি শুধুমাত্র এক দশকের উষ্ণায়নের ফলেই হয় না বরং কয়েক দশকের পর্যায়ক্রমিক উষ্ণায়নেরই ফলাফল মাত্র”।
নতুন প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা বেশকিছু অনুসিদ্বান্তে উপনিত হয়েছেন যার সারসংক্ষেপ এভাবে তুলে আনা যায়ঃ
প্রতিবেদনে জলবায়ুর একেক ক্ষেত্রের পরিবর্তনের মাত্রাকে তিনটি সূক্ষ ও বিতর্কহীন ভাষ্যে চিহ্নিত করেছেন যথা-
“কার্যত নির্দিষ্ট” যা ৯৯-১০০% নিশ্চয়তা নির্দেশ করে।
“খুব সম্ভব” যা ৯০-১০০% নিশ্চয়তা নির্দেশ করে।
“সম্ভাব্য” যা ৬০-১০০% নিশ্চয়তা নির্দেশ করে।
প্রথম অনুসিদ্ধান্তে আবহাওয়ার চরম ভাবাপন্নতার দিকে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যা তারা “খুব সম্ভব” ভাষ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং যার প্রমাণস্বরুপ উল্লেখ করা হয় যে ১৯৫০ সাল থেকে শীতল দিন ও রাতের পরিমান হ্রাস পেয়েছে এবং উষ্ণ দিন ও রাতের পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বেড়ে গেছে, যা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, সমুদ্রের উষ্ণায়নকে “কার্যত নির্দিষ্ট “এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, সমুদ্রের পৃষ্ঠতল হতে ২৪৬ ফুট(৭৫ মিটার) গভীরতার মধ্যে ১৯৭০ সাল থেকে প্রতি দশকে ০.২° ফারেনহাইট(০.১১° সেলসিয়াস) হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। সমুদ্রের অম্লায়নে জীবাশ্ম জ্বালানী দহনে উৎপন্ন অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডের অবদানকে “খুব সম্ভব” শিরোনামের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে যা সামুদ্রিক প্রবাল, জীব এবং খাদ্য জাল তথা বাস্তুসংস্থানের উপর মারাত্নক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
তৃতীয়ত, মেরু ভালুকের অস্তিত্বও আজ জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে হুমকীর সম্মুখীন। এর কারন হিসেবে ১৯৭০ সাল থেকে সামুদ্রিক বরফের গলনকে উল্লেখ করা হয়েছে যা “খুব সম্ভব” শিরোনামের অন্তর্গত। ১৯৯৩ সাল থেকে সমুদ্রের বরফ গলনের হার তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে শুধুমাত্র এন্টার্ক্টিকাতেই সামুদ্রিক বরফ বাড়ছে। সুমেরু অঞ্চলে ১৯৭৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি দশকে প্রায় ৩.৫ থেকে ৪.১% হারে বরফ গলন হয়েছে।
চতুর্থত, সমুদ্রের পৃষ্ঠতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আরো বাড়তে থাকবে যা উক্ত প্রতিবেদনে বিশ্লেষন করা হয়েছে। ১৯০১ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সমুদ্রের গড় উচ্চতার ৭.৫ ইঞ্চি(০.১৯ মিটার) বৃদ্ধি ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে ইহা “কার্যত নির্দিষ্ট” মাত্রায় বৃদ্ধি পাবে বলেও প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। এতে অবশ্য প্রত্যাশা করা হচ্ছে যে, যদি এন্টার্কটিকায় বরফের পাতগুলো ধ্বসে না পড়ে তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২১০০ সাল নাগাদ ৩.২২ ফুট(০.৯৮ মিটার) এর বেশি বৃদ্ধি পাবে না।
পঞ্চম এবং সর্বশেষ অনুসিদ্ধান্তে বলা হয়েছে , ১৯৫০ সাল থেকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের যে ধারাগুলো পর্যবেক্ষন করা হয়েছে তার অর্ধেকেরও বেশির পিছনে মানবসৃষ্ট কারন রয়েছে, যা প্রধানত জীবাশ্ম জ্বালানী দহনের ফলে নিঃসরিত কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রভাবে সংঘটিত হয়েছে। প্রতিবেদনে সতর্কবানী করা হয়েছে, যদি সাম্প্রতিক হারে গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরিত হতে থাকে তবে বৈশ্বিক উষ্ণতা “কার্যত নির্দিষ্ট” এর অন্তর্ভূক্তিতে পরিচালিত হবে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মহাসচিব মিশেল জেরার্ড বলেন,” যদি আমরা তাৎক্ষণিকভাবে কোন পদক্ষেপ না নেই, তবে পৃথিবীর তাপমাত্রা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পাবে”। স্টকার প্রতিবেদন প্রকাশের ব্রিফিংয়ের পরিসমাপ্তিতে বলেন,” আমরা শিরোনামের জন্য কাজ করি না বরং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তৈরী করি” তিনি আরো বলেন,” জলবায়ু পরিবর্তন মানব জাতির প্রধান দুটি সম্পদ যথা মাটি ও পানির গুনাগুণকে চ্যালেঞ্জ করে এবং এটি আমাদের গ্রহকেও চ্যালেঞ্জ করে যা আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র আশা এবং অবলম্বন”।
সূত্রঃ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক