জমাট বরফ রহস্য !!!!
মাহবুব রেজওয়ান
টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলেই হরদম চোখে পড়ছে দাঁত আর হাড়ের গঠন মুজবুত করতে পালোয়ান, সকল শক্তিতে আর পুষ্টিতে ভরপুর বিভিন্ন রকম পরিপূরক খাদ্যের বিজ্ঞাপন। আবার টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনও আছে, যাতে ঘোষণা দেয়া হয় সেই টুথপেস্ট ব্যবহারে আপনার দাঁত হবে ক্যালসিয়াম যুক্ত আর মজবুত।দাঁত বা হাড় মজবুত হওয়ার পেছনে কাজ করে প্রোটিন আর মানুষের দাঁত ও হাড়ের গঠনে রয়েছে প্রোটিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাছাড়াও ফসলী জমিতে ফসল উৎপাদনেও প্রোটিনের ভূমিকা রয়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন বরফ তৈরিতেও কিছু কিছু প্রোটিন নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। কিছু কিছু প্রোটিনের এই অদ্ভুতুড়ে ক্ষমতা রয়েছে, যারা অস্বাভাবিক তাপমাত্রাতেও বরফ তৈরি করতে পারে। এই তথ্যটি যে শুধুমাত্র পরিবেশ ও কৃষি সম্পর্কিত বেক্তিদেরই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, তা নয়। যারা মাউনটেইন স্কি রিসোর্ট( যেখানে বরফ একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান) নিয়ে কাজ করছেন তাদের মনোযোগও গভীরভাবে কাড়তে সক্ষম হয়েছে। বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন কিভাবে ব্যাকটেরিয়াল প্রোটিন পানির অণুর সাথে কাজ করে তা বরফে পরিণত করে।
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সিটিউট ফর পলিমার রিসার্চের সারফেস প্রোটিন গ্রুপের প্রধান; প্রাণ- প্রকৌশলবিদ টোবিয়াস ভিডনার তাঁর গবেষণা পত্রে জানান, আকাশের তথা বায়ুমণ্ডলের ব্যাকটেরিয়াল প্রোটিন বৃষ্টিপাতের ধরণ নিয়ন্ত্রন করতে পারে। তিনি এই প্রোটিনগুলোর ব্যাপারে অত্যন্ত কৌতূহলী ছিলেন। কিন্তু গবেষণা করতে গিয়ে লক্ষ্য করেন, এদের নিয়ে মাইক্রোস্কপিক লেভেলে তেমন কোন কাজ হয় নি।
ভিডনার এবং তাঁর সহকর্মীরা গবেষণা করেছিলেন সিউডোমনাস সিরিঞ্জা (Pseudomonas syringae) নামক ব্যাকটেরিয়া নিয়ে। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো; তাপমাত্রা শুন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে থাকা সত্ত্বেও গাছের উপর বরফের ক্রিস্টাল তৈরি করতে সক্ষম!!! এর মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়াগুলো গাছকে আক্রমণ করে।
এই ব্যাকটেরিয়াদের নিয়ে ভিডনার বলছেন, “ এরা অনেকটা ফলের উপর উড়তে থাকা মাছির মতো। এরা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বাতাসের সাথে ঘুরে বেড়ায়। উদ্ভিদ এবং কৃষি প্রধান এলাকায় এদের বেশি দেখা গেলেও বরফে ঢাকা এন্টারটিকাতেও এদের দেখা মেলে যেখানে আদতে কোন কিছুই জন্মায় না”।
গবেষকদল গাছ থেকে এই ব্যাকটেরিয়ার কিছু নমুনা সংগ্রহ করেন এবং পরীক্ষার জন্য পানির উপর একটি ফিল্ম তৈরি করেন। এরপর তারা লেজার রশ্মির মাধ্যমে নমুনাটির উপর খুব সূক্ষ্ম একটি বিস্ফোরণ ঘটান,যার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৪০ ফেমটো সেকেন্ড(এই সময়ে আলো এক মিলিমিটারের একশ ভাগের এক ভাগ দূরত্ব অতিক্রম করে) এই পরীক্ষার মাধ্যমে তারা দেখতে চেয়েছিলেন প্রোটিনের আণবিক গতি এবং কক্ষ তাপমাত্রায় রাখা পানির মধ্যে এর কীরূপ প্রভাব পরে।
তারা লক্ষ্য করলেন,বিস্ফোরণের পর পানির অণু নিজের সঞ্চিত শক্তি চারপাশের পানির স্তরে ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা পানি বরফ হওয়ার সময় ঘটে থাকে। কিন্তু প্রোটিন অণুর উপর কোন প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। বিজ্ঞানীরা প্রোটিনগুলোর নাম দেন আইস নিউক্লিয়েটর; কারণ তারা নিজেদের গাঠনিক পরিবর্তন না করেই নিজেদের চারপাশে বরফের ক্রিস্টাল তৈরি করতে সক্ষম।
ভিডনার বলেন, এই ধরনের ঘটনা সাধারণত কোন প্রোটিনের ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা যায় না। তিনি আরও বলেন, এই পরীক্ষা কাজে লাগিয়ে কৃত্তিমভাবে বরফের ক্রিস্টাল তৈরি করা সম্ভব। তাছাড়া, আকাশে কিভাবে মেঘ তৈরি হয় এবং কিভাবে বৃষ্টি পরে সে সম্পর্কেও নতুন তথ্য জানা যাবে। তবে এই আইস নিউক্লিয়েটরগুলো কক্ষ তাপমাত্রায় একেবারেই সাধারণ প্রোটিনের মতো আচরণ করে।
এভিএস (AVS) ৬০ তম ইন্টারন্যাশনাল সিমপোজিয়াম এন্ড এক্সিবিশনে ভিডনার তার নতুন গবেষণাটি উপস্থাপন করেন। যা গত মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচে অনুষ্ঠিত হয়।
ডেনমার্কের আরহুস ইউনিভার্সিটির পোস্ট ডকটোরাল রিসার্চার টিনা সেনটল টেমকিভ বলেন, “মেঘের গঠনে আইস নিউক্লিয়েটিং ব্যাকটেরিয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে জানা গেলেও বায়ুমণ্ডলে তাদের প্রকৃত ভূমিকা এখনো রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। আইস নিউক্লিয়েটিং ব্যাকটেরিয়ার কার্যবিধি সম্পর্কে আমাদের আরও জানতে হবে।”
তবে ঘটনা যাই ঘটুক না কেন, বিজ্ঞান আমাদের আরও একবার চমৎকৃত করেছে, অকোষীয় আর এক কোষী প্রাণের বৈচিত্র্য আর কর্মক্ষমতার নতুন নতুন প্রদর্শনী একবিংশ শতাব্দীর সুপার ফাস্ট সভ্যতার জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ, সেটি বুঝতে আরও কিছুটা হিসাব নিকাশ প্রয়োজন বৈকি!!!