চিতাবাঘের ছানা!!

শরীফ খান

এইচএসবিসি-প্রথম আলো ভাষা প্রতিযোগ-২০১৩ উপলক্ষে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জে গিয়েছিলাম আমরা কজন। রাত যাপন করি নরসুন্দা নদীপারের এক হোটেলে। অনুষ্ঠান ১৩ এপ্রিল সকালে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে আমি হোটেলের পেছনের নরসুন্দা নদীটি দেখতে থাকি। প্রায় মরে গেছে নদীটি। কচুরিপানায় ভর্তি। ওই ভোরেই অনেক কানিবক খাবার খুঁজতে দাপিয়ে-ঝাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে কচুরিপানার ভেতরে। হঠাৎ নজরে পড়ে, পাঁচ-ছয়জন কিশোর-তরুণ কিছু একটা ঘিরে মহাব্যস্ত। ভাবলাম, কোনো বড় মাছ হয়তো ধরেছে কচুরিপানার ভেতর থেকে। নেমে এলাম রাস্তায়। একটু ঘুরপথে আমি পৌঁছে গেলাম ওদের কাছে। না, মাছ নয়। একটি প্রাণীর দু-তিন মাস বয়সী ছানা। প্রশ্ন করতেই ওরা জানাল, এটি চিতাবাঘের ছানা, দুই হাজার টাকায় জামালপুর থেকে কিনে এনেছে। কিশোরগঞ্জের কেউ একজন তিন হাজার টাকায় কিনতেও চেয়েছে। বাঘের বাচ্চা বলে কথা! ফিডারে দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা যাবে।2013-05-20-20-35-22-519a890a86ee1-untitled-34
পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে ওদের আমি কিছুই বললাম না। এর আগে আমার কমপক্ষে এ রকম ৩০টি অভিজ্ঞতা আছে। ‘চিতাবাঘের বাচ্চা’ খবরে ছুটে গেছি ঘটনাস্থলে এবং একবার ছাড়া প্রতিবারই বনবিড়ালের ছানা দেখে হতাশ হয়েছি। একবারই পেয়েছিলাম মেছো বাঘের বাচ্চা।
হ্যাঁ, এটিও বনবিড়ালের ছানা। কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ-ও নিশ্চিত, যতই বলি না কেন, এই তরুণ-কিশোরদের বিশ্বাসকে টলাতে পারব না আমি। চিতাবাঘের বাচ্চা বলে বিশ্বাস করেই জামালপুর থেকে ওরা কিনে এনেছে। আবার ওরা যাদের কাছে বিক্রি করবে, তারাও চিতাবাঘের বা বাঘের বাচ্চা ভেবেই কিনবে। তবে যারা বিক্রি করেছে, তারা অবশ্য ভালো করেই জানে যে এটি বাঘ নয়, বনবিড়ালের বাচ্চা।
খুবই দুঃখজনক ঘটনা এগুলো। জীববৈচিত্র্যের জন্যও চরম হুমকিস্বরূপ। এককালে বনবিড়াল বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামেই ছিল, এখন অবস্থা পাল্টেছে। বাঘের বুনোমাসি এই প্রাণিটি তুখোড় শিকারি। চতুর, বুদ্ধিমান ও দুর্দান্ত লম্ফবিদ। গাছে ভালো চড়তে পারে। এদের শিকার ধরার কৌশল দেখার সুযোগ জীবনে আমি বহুবার পেয়েছি। হয়তো মাটিতে চরতে থাকা একটি ঘুঘুকে লাফ দিয়ে চেপে ধরল ডান থাবার তলায়। প্রচণ্ড শক্তিতে শিকার চেপে ধরবে মাটিতে। তারপর বেলুন দিয়ে পিঁড়িতে রুটি বেলার মতো বেলবে দু-তিনবার। ব্যস, শিকারের জীবন শেষ। তারপর মুখে ধরবে শিকার।
বনবিড়াল বছরে ছানা তোলে দু-তিনবার। প্রতিবারই দু-তিনটি ছানা হয়। এরা পোষ মানে, কিন্তু বড় হয়ে জঙ্গলের টানেই হারিয়ে যায় জঙ্গলে।
কিশোরগঞ্জের ওই ছানাটি হয়তো বাঘের বাচ্চা হিসেবে হাতবদল হবে, বেঁচেও থাকবে ‘বাঘযত্নে’। কিন্তু এটি যে বাঘের বাচ্চা নয়, তা বোঝানোর জন্য বন্য প্রাণীর কারবারি চক্রটিকে প্রতিরোধ করতে উদ্যোগ নেওয়া খুবই জরুরি আজ।
বনবিড়ালের ইংরেজি নাম Jungle Cat। মাপ সাধারণ পোষা হুলো বিড়ালের চেয়ে কিছুটা বড়। লেখার সঙ্গে যে ছবিটি ছাপা হলো, সেটিও চিতাবাঘের বাচ্চা হিসেবে মধুপুর জঙ্গল থেকে কিনে এনেছিল আমার এক সহকর্মীর কলেজে পড়ুয়া ছেলে। পরে ওটিকে মধুপুরে অবমুক্ত করা হয়েছিল।

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো (২১/০৫/২০১৩)

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics