"বিষাক্ত খাদ্যের বর্তমান অবস্থায় করণীয়"- শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন

এনভায়রনমেন্টমুভ ডেস্ক

আশংকাজনক হারে রোগব্যাধি বৃদ্ধিসহ সম্প্রতি কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় শিশুর করুণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে খাদ্যে বিষাক্ত ও ভেজালের ভয়াবহতার দিকটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন থেকে বাজারজাত করা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এই বিষাক্ত ও ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট আইনসমূহের যথাযথ বাস্তবায়নের পাশাপাশি সময়োপযোগী কীটনাশক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা জরুরী। পবা ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ফলমূলের ফরমালিন পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফল ও বিষাক্ত খাদ্যের বর্তমান অবস্থায় করণীয় তুলে ধরতে আজ ০৬ জুলাই ২০১৫, সোমবার, সকাল ১১ টায় পবা কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উক্ত দাবী জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়- অসচেতন কৃষক, অতি মুনাফালোভী মজুতকারী, পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতা খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি, ডিডিটি, কীটনাশক, কাপড়ের রং, ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথেফেন ব্যবহার করছে। কৃষিজাত পণ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও কীটনাশক, ফল, মাছ, শাকসবজিতে ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করা হচ্ছে। মিষ্টিতে কাপড়ের রং প্রয়োগ করা হয়। শুটকি মাছ সংরক্ষণে ডিডিটি ও হেপ্টাক্লোর ব্যবহার করা হয়। ডিডিটি, অ্যালড্রিন, ক্রোমিয়াম, কার্বামেট, আর্সেনিক, সীসা সবই মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কৃষিতে কীটনাশকের ব্যাপক অপপ্রয়োগ দেশের জনস্বাস্থ্যকে বিশাল ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। কৃষিপণ্যকে কীটনাশক থেকে রক্ষা করা গেলে মানুষ অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত হতে পারে। খাদ্যে যেসব রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়, তাতে হৃদপিন্ড, পাকস্থলী, কিডনি ও লিভারের রোগ এবং ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক।

unnamed (2)
খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে সাম্প্রতিককালে ৮২টি খাদ্যপণ্য পরীক্ষা করা হয়। এতে গড়ে ৪০ শতাংশ খাদ্যেই মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি নিষিদ্ধ ডিডিটি, অ্যালডিন, ক্লোরডেন, হেপ্টাক্লোর এবং অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান পাওয়া যায়। ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাকসবজির নমুনাতেই বিষাক্ত বিভিন্ন কীটনাশকের উপস্থিতি মিলেছে। চালের ১৩টি নমুনায় মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত বিষক্রিয়া সম্পন্ন আর্সেনিক, পাঁচটি নমুনায় পাওয়া গেছে ক্রোমিয়াম। হলুদের গুঁড়ার ৩০টি নমুনায় ছিল সীসা ও অন্যান্য ধাতু। লবণেও সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২০-৫০ গুণ বেশি সীসা পাওয়া গেছে। মুরগির মাংস ও মাছে পাওয়া গেছে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব।

ঢাকা মহানগরে দেশি ও বিদেশি ফলে ফরমালিনের অবস্থা নিরুপণের লক্ষ্যে পবা ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ১০ জুন থেকে ৫ জুলাই ২০১৫ পর্যন্ত আম(১৩টি), জাম(৪টি), লিচু (৪টি), আপেল(৯টি), আঙ্গুর(৬টি), মালটা(৬টি), কলা, (৩টি) পেয়ারা(৩টি), আনারস(৪টি), জামরুল(২টি),শশা (২টি) ও খেজুরের(৫টি) মোট ৬১টি নমুনার ফরমালিন পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব ফল বিভিন্ন বাজার ও এলাকা হতে ক্রয় করে পবা কার্যালয়ে পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ১০ শতাংশ নমুনায় (জামের ৪টি নমুনার ৩টি, খেজুরের ৫টি নমুনার ২টি এবং জামরুলের ২টি নমুনার ১টিতে) ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়।

পবার চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা: লেলিন চৌধুরী, সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল, এডভোকেট হাসান তারিক চৌধুরী, সহ-সম্পাদক মো: নজরুল ইসলাম, সহ-সম্পাদক মো: সেলিম, শাহীন আজিজ, পরিবেশ উন্নয়নসোসাইটির সভাপতি বুরহান উদ্দিন আহমেদ, ইউনাইটেড পিপলস ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক আলী হাজারী প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলন থেকে নিন্মেক্ত সুপারিশসমূহ করা হয় :

• ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৫ এবং নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ দ্রুত বাস্তবায়ন করা।

• সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ রাসায়নিক পদার্থের আমদানিকারক ও ব্যবহারকারী এবং লেবেল ছাড়া বা মিথ্যা লেবেলের অধীন কীটনাশক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

• সময়োপযোগী কীটনাশক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা ।

• দেশের চাহিদা অনুযায়ী টিসিবির মাধ্যমে ফরমালিন আমাদানি করা।

• পণ্য আমদানি পর্যায়ে এনবিআর কর্তৃক বন্দরসমূহে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদি পরীক্ষা করা।

• দেশের বিদ্যমান গবেষণাগারসমূহের সক্ষমতা অনুযায়ী সেগুলোকে খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি, ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড পরীক্ষার নির্দেশনা প্রদান করা এবং একটি আধুনিক গবেষণাগার স্থাপন করা।

• শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপনে শিল্প মালিকদের বাধ্য করা। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

• কোন রকম রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই খাদ্য সংশ্লিষ্ট আইনসমূহ প্রয়োগে সরকারের প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

• প্রতি জেলায় খাদ্য আদালত স্থাপন এবং জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক খাদ্য পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা।

• খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা।

• খাদ্যদ্রব্যে ডিডিটিসহ অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ, রাসায়নিক রং, ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড মিশানোর দায়ে অভিযুক্তদের আইনে বর্ণিত সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনা। অন্যথায় জনগণ বিশেষ করে শিশুদের কোনভাবেই বিষযুক্ত খাদ্যের ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা যাবে না।

• বিষযুক্ত খাদ্যের ভয়াবহ বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে দেশে জৈব কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন ও একে জনপ্রিয় করে তোলা জরুরি। যা জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রকেও রক্ষা করবে। জৈব কৃষি ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করতে কৃষক, বিক্রেতা ও ভোক্তাদের মধ্যে সচেনতা সৃষ্টি করতে হবে। রাসায়নিকযুক্ত খাদ্য উৎপাদন ও বিপনন ব্যবস্থাকে নিরুৎসাহিত করে জৈব খাদ্য উৎপাদন ও বিপনন ব্যবস্থা শক্তিশালী করার লক্ষে দেশব্যাপী প্রচারণা চালাতে হবে।

• ফল ও সবজি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। ফল ও সবজি আমাদের পুষ্টি, ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের চাহিদা মেটায়; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। কিন্তু অসাধু বিবেকবর্জিত ব্যবসায়ী চক্রের দুষ্কর্মের কারণে ফল ও সবজি পরিণত হয়েছে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং আশংকার বিষয়। আমরা নিরাপদ ফল ও সবজি গ্রহণ করতে চাই। ফল ও সবজির চাষাবাদ এবং বাণিজ্যের প্রসার চাই। কিন্তু যাদের অপকর্মের জন্য ফল ও সবজিসহ কৃষিপণ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য আতংকের বিষয়ে পরিণত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি এ বিষয়ে জনগণকে অধিকতর সচেতন করতে হবে।

• বিষমুক্ত খাদ্য নিশ্চিতকরণে সরকারি কর্মচারীদের বিদ্যমান আইন সততার সাথে প্রয়োগ করতে হবে।

• “স্টকহোম কনভেনশন অন পারসিস্ট্যান্ট অরগানিক পলিউট্যান্টস” এর স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে “দ্যা ডার্টি ডজন” এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে জরুরীভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণ করা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics