জলবায়ু স্থানচ্যূত মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন কার্যকর নীতিমালা ও আইনি সহায়তা

এনভায়রনমেন্টমুভ ডেস্ক

সাম্প্রতিক বন্যায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষ স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে স্থানচ্যূত হতে বাধ্য হয়েছে। পুরোপুরি ও আংশিকভাবে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে যাওয়া ও তলিয়ে যাওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করে তাদের সমস্যা ও প্রাপ্য অধিকারের নিশ্চয়তার জন্য আইনজীবিরা পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা ( লিগ্যাল এইড অফিস) আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও স্থানচ্যূত ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা প্রদান করবে। সমাজ উন্নয়ন সংস্থা ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশন (ইপসা) ও লয়ার্স ইনিশিয়েটিভ ফর ডিসপ্লেসমেন্ট সল্যুশনসের যৌথ উদ্যোগে চট্টগ্রামের একটি অভিজাত হোটেলে “ওরিয়েন্টশান ফর লয়ার্স অন ক্লাইমেট ডিসপ্লেসমেন্ট এন্ড রাইটস অব ক্লাইমেট ডিসপ্লেসড পারসন” শিরোনামে গত ১০ মে’ ২০১৫ ইং আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। উক্ত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারি জজ মুজাহিদুর রহমান।

DSC02684

ইপসার প্রোগ্রাম ম্যানেজার শ্যামশ্রী দাশের সঞ্চালনায় চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবি সমিতির পাঠাগার সম্পাদক ও লয়ার্স ইনিশিয়েটিভ ফর ডিসপ্লেসমেন্ট সলুশনের আহ্বায়ক এডভোকেট শওকত আওয়াল চৌধুরীর সভাপতিত্বে গোলটেবিল আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন ইপসার বাংলাদেশ হাউজিং, ল্যান্ড এন্ড প্রোপার্টি রাইস প্রকল্পের টিম লিডার মোহাম্মদ শাহজাহান। এরপর ’জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষের অধিকার ও আইনজীবীদের সক্ষমতা অর্জন’ শীর্ষক সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইপসার এর্ইচএলপি প্রকল্পের প্রোগ্রাম অফিসার প্রবাল বড়ুয়া। তিনি সাম্প্রতিক বন্যায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে সংগঠিত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির বিবরণী উল্লেখ করে স্থানচ্যূত মানুষের দুরাবস্থার পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষের পুনর্বাসন সহ প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সরকারের দায়বদ্ধতার কথা তুলে ধরেন।

গোলটেবিল আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধের উপর আলোচনা করেন জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার প্যানেল আইনজীবী ও লয়ার্স ইনিশিয়েটিভ ফর ডিসপ্লেসমেন্ট সল্যুশনের সদস্য সচিব এডভোকেট মো. মোজাম্মেল আলী চৌধুরী ( জামাশেদ), এডভোকেট সাকিয়া জিয়াছমিন, এডভোকেট মো. হাছান মুরাদ, এডভোকেট মৌমিতা দাশ গুপ্ত, এডভোকেট ইশহাক আহমেদ প্রমুখ। ।

উল্লেখ্য, জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনগত সহায়তা ও এ লক্ষ্যে এডভোকেসি করার উদ্দেশ্যে ইপসা ২০১৩ সালে প্রথম চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবি সমিতির সহযোগিতায় প্রথমবারের মতো আইনজীবীদের সাথে বৈঠক করে। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের জুলাই মাসে এডভোকেট শওকত আওয়াল চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও এডভোকেট মো. মোজাম্মেল আলী চৌধুরী ( জামাশেদ) সদস্য সচিব হিসেবে লয়ার্স ইনিশিয়েটিভ ফর ডিসপ্লেসমেন্ট সল্যুশনের (লিডস) ৮ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইপসা ও লিডসের যৌথ এ আলোচনা সভায় আইনজীবীরা বলেন, জলবায়ু স্থানচ্যূত মানুষের কার্যকর পুনবার্সন ও বাস্তবতার নিরিখে জলবায়ু পরিবর্তন ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালায় স্থানচ্যূত মানুষের অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করা ও সরকারি খাস জমি বরাদ্দে সচ্ছতার ভিত্তিতে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে অভিমত প্রদান করেন। এ ব্যাপারে তারা জেলা ভিত্তিক বাস্তুচ্যূত/ স্থানচ্যূত মানুষের সঠিক পরিসংখ্যান ও বঞ্চনার তথ্যবহুল উপাত্ত সংগ্রহের পর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানান।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারি জজ মুজাহিদুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইড অফিস প্যানেলভুক্ত আইনজীবিদের মাধ্যমে যাদের মামলা পরিচালনা করে সেই অসহায় মানুষের সবাই জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষ হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চট্ট্গ্রামে বসবাস করা মানুষ। কিন্তু মামলাগুলো বেশীরভাগই নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ক। একজন ভূমিহীন যদি সরকারি খাস জমি বন্টনে বঞ্চনার শিকার হয়, গুচ্ছগ্রাম বা আদর্শ গ্রাম এবং আশ্রয়ন প্রকল্প সহ সরকারি পুনবার্সন প্রকল্পের মুল উদ্দেশ্য ও সুবিধা থেকে স্থানচ্যুত মানুষেরা যদি অবহেলিত হয় তবে তারা যদি তাদের প্রাপ্য অধিকার দাবী করে আমরা তাদের সর্বাত্বক আইনি সুবিধা প্রদান করব। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে অথচ এর জন্য উন্নত বিশ্বের ভূমিকাই বেশী। এজন্য তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত।

প্রধান অতিথি মুজাহিদুর রহমান আরো বলেন, ২০১৪ সালে প্রণীত আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা অনুযায়ী নিরাশ্রয় ব্যক্তি, আদর্শ গ্রামে গৃহ বা ভূমি বরাদ্দপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি, অসচ্ছল বিধাব এবং দুস্থ মহিলা, আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে আদালতে অধিকার প্রতিষ্ঠা, অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন, নানাবিধ আর্থ-সামাজিক এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কোন ব্যক্তি যিনি আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা বা মামলা পরিচালনায় অসমর্থ মানুষেরা সরকারি আইনগত সহায়তা কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত আইনগত তথ্য সেবা গ্রহণ, আইনগত পরামর্শ গ্রহণ কিংবা বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির সেবা গ্রহণের জন্য যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হবেন। আর এইসব শ্রেণীতে জলবায়ু স্থানচ্যূত মানুষরা তাদের ন্যায্য প্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যেকোন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে চট্টগ্রাম জেলা সহ দেশের ৬৪টি জেলার লিগ্যাল এইড অফিস তাদের পাশে দাঁড়াবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এ ব্যাপারে ইপসা ও লিডসকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
উক্ত ওরিয়েন্টশন প্রোগ্রামে ইপসা ও ডিসপ্লেসমেন্ট সলুশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ” জলবায়ু স্থানচ্যূত মানুষের অধিকার বিষয়ক সহজ নির্দেশিকা” শীর্ষক প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এ প্রসঙ্গে ইপসার এইচএলপি প্রকল্পের টিম লিডার মো. শাহজাহান বলেন, প্রকাশিত নির্দেশিকাটির লক্ষ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনে যেসব মানুষ তাদের ঘরবাড়ি এবং ভূমি থেকে স্থানচ্যূত হয়েছে তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার কী করণীয় সে বিষয়ে সহজ ও ব্যবহার উপযোগী দিকনির্দেশনা প্রদান করা। এটি জলবায়ু স্থানচ্যূত মানুষ এবং তাদের সহায়তকারীদের দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই নির্দেশিকায় সহজ ভাষায় জলবায়ু স্থানচ্যূতি কী, জলবায়ু স্থানচ্যূত মানুষ হিসেবে আপনার কী কী অধিকার প্রাপ্য এবং অধিকারসমূহ আপনি কিভাবে রক্ষা করতে পারেন সে বিষয়ে ব্যাখা করা হয়েছে। জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জলবায়ু স্থানচ্যূতির শিকার হওয়া জনগোষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তিগতভাবে এবং সম্মিলিতভাবে দাবী আদায়ে সোচ্চার হতে হবে।

উল্লেখ্য, সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক সংস্থা ডিসপ্লেসমেন্ট সল্যুয়েশন-এর সহযোগিতায় ইপসা ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ হাউজিং, ল্যান্ড এন্ড প্রোপার্টি রাইটস ইনিটিয়েটিভ শিরোনামে জলবায়ূ স্থানচ্যূত মানুষের সমস্যা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজন সম্পর্কিত বেশ কিছু নীতিমালা বাংলাদেশ সরকারের থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনে স্থানচ্যূত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোন নীতিমালা গ্রহণ করেনি। এই নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে ইপসা বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে এবং প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার সংবাদকর্মীদের সাথে মতবিনিময় করে যাচ্ছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading