সূর্যালোকে নিরাপদ পানিঃ আশাজাগানিয়া ঢাবি গবেষণা
পানি আমাদের মৌলীক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান উপাদান। এটি একই সাথে জীবন ও মৃত্যুর নামান্তর। দুষিত পানি পানের ফলে তৃতীয় বিশ্বের প্রায় অর্ধ মিলিয়ন মানুষ প্রতিবছর পানিবাহিত রোগে মারা যায়। যদিও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই নিরাপদ পানির জন্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে, তথাপি দুষিত খাবার পানি এখনো তৃতীয় বিশ্বের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য এক বিরাট হুমকি হয়ে রয়েছে। এই হুমকি মোকাবিলায় নানা দেশ এবং সংস্থা বিভিন্ন গবেষনা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। “তৃতীয় বিশ্বের গ্রামীন অঞ্চলের জন্য সৌরশক্তি ব্যবহার করে পানি বিশুদ্ধকরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদ্ধতি” নামক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণায় একটি কার্যকর ফলপ্রসু পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে। উক্ত গবেষণায় ভূ-গর্ভস্থ পানিশোধণের পরিবর্তে ভূ-উপরস্থ পানিশোধণের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সৌরশক্তি ব্যবহার করে পানি বিশুদ্ধকরণের ভিত্তিতে স্বল্পমুল্যের অর্ধস্থায়ী এমন একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করা যা গ্রামীন এলাকার মানুষদের সহজে জীবানুমুক্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে পারে। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের আরেকটি গ্রুপ উক্ত গবেষণার আগেও এই বিষয়ে বিভিন্ন পদ্ধতির উন্নয়ন সাধন করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদ্ধতির মুলনীতি হচ্ছে ভূ-উপরস্থ পানি বিশোধনে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি ও তাপ শক্তির ব্যবহার। এই পদ্ধতি খুবই স্বল্প খরচের এবং ব্যবহারকারীবান্ধব এবং পানিতে উপস্থিত প্রায় সকল জীবাণুকে ধ্বংস করতে সক্ষম। এই যন্ত্রটি তৈরী করতে আমাদের প্রয়োজন পলিথিন অথবা পলিস্ট্যারিন ফোম, একটি কন্টেইনার, তাপ রোধক পদার্থ যেমন খড় এবং এসব কিছু ধরার জন্য একটি ধারক। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রাব্বানী উক্ত পদ্ধতিটির পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধন করেছেন। তার গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যন্ত্রটির গঠনগত উন্নয়ন সাধনে নিম্নস্থ তাপ নিরোধক এবং বায়ু স্তরের অত্যানুকুল পুরুত্ব নির্ণয় এবং সবচেয়ে কার্যকরী বিশোধন পদ্ধতি উদ্ভাবনে বিবেচ্য প্রভাবকগুলোর নিরীক্ষা করা।
উক্ত যন্ত্রটিকে আরো উপযুক্ত ও কার্যকরী প্রমাণ করার জন্য গবেষকরা বিভিন্ন পরীক্ষা চালিয়েছেন যেমন শীতলীকরন পরীক্ষা, সৌরতাপীয় পরীক্ষা, অনুজীববিজ্ঞানিক পরীক্ষা, পদার্থ এবং ব্যবহারকারী বান্ধবতা ইত্যাদি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদ্ধতিটি সকল পরীক্ষাতেই যন্ত্রটির সর্বোৎকৃষ্টতা প্রমান করেছে। অনুজীব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা গেল, ২ ঘন্টা তাপ দেয়ার পর ৭৫.৩৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কোন ক্ষতিকর জীবানু সেখানে ছিল না। যেসকল জীবানু ধ্বংস হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ই কোলাই, টি এস এ, টি ও টি ইত্যাদি অক্সিজেননির্ভর ব্যাক্টেরিয়া। এই ব্যাক্টেরিয়াগুলোই বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের প্রধান অনুঘটক। উক্ত পানিকে ২৫° সেলসিয়াস পর্যন্ত ঠান্ডা করার পরে এটি নিরাপদ খাবার পানির সকল মানদন্ড অর্জন করে। এতে সংযুক্ত আগমন ও নির্গমন নালী এটির ব্যবহারকারী বান্ধবতা প্রমান করে। সংযুক্ত আগমন ও নির্গমন নালী পানি পূর্ণ ও খালি করার সবচেয়ে সহজ উপায় স্থাপন করেছে। ফেনার উৎপাদন কমানোর ক্ষেত্রেও এটি কার্যকরী পদ্ধতি। এই যন্ত্রটি একেবারে প্রায় ১১ লিটার বিশুদ্ধ খাবার পানির যোগান দেয়। তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে যার প্রধানটি হচ্ছে যন্ত্রটি পানি থেকে রাসায়নিক পদার্থ দূর করতে পারেনা।
পৃথিবী জুড়ে বর্তমানে অন্যান্য আরো আশাপ্রদ পদ্ধতির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, যার মধ্যে রয়েছে, সডিস পদ্ধতি, যেখানে কন্টেইনারের পরিবর্তে PET বোতল ব্যবহার করা হয় এবং আরেকটি হচ্ছে সলভাটেন পদ্ধতি যেখানে গৃহস্থালী ক্ষেত্রে তাপ দিতে এবং পানি শোধনে কালো কন্টেইনার ব্যবহার করা হয়। সকল পদ্ধতির মধ্যে তুলনা করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদ্ধতিটিই সবচেয়ে সস্তা এবং সহজে তৈরি এবং স্থাপন যোগ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদ্ধতিটি যেসকল পদার্থ ব্যবহার করে সেগুলো গ্রামীন এলাকায় সহজলভ্য তাই এটি সহজে তৈরী করা যায় যা কমসময় ব্যয় করে এবং যাতে খরচের পরিমানও খুবই কম যা ১-২ ডলার বা বাংলাদেশি ১৫০ টাকা। সোডিস পদ্ধতি যদিও সস্তা,তবে এটি মুক্ত মূলক বা ফ্রি রেডিকেল অপসারন করতে পারেনা তাই এর দক্ষতা তুলনামুলক কম। সলভাটেন পদ্ধতিটি ব্যয়বহুল এবং কন্টেইনারটি গৃহস্থালী ক্ষেত্রে স্থাপন করা সম্ভব নয় তাই এটা গ্রামীন জনগনের জন্য উপযোগী না। গবেষকরা উপসংহার টেনেছেন এই বলে যে, অর্ধস্থায়ী যন্ত্রটিই কম খরচে নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহ করবে এবং ইহার ব্যবহারকারী উপযোগীতা রয়েছে তাই ইহা গ্রামীন অঞ্চলে ব্যবহার করা যাবে। তাই আমরা আশা করি এই গবেষণা আমাদেরকে পৃথিবীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ খাবার পানির নিশ্চয়তা প্রদানে সহায়তা করবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর এবং নিরাপদ পানি সংবলিত পৃথিবী প্রতিষ্ঠায় নিশ্চয়তা দিবে।
ইসমাম হ্রিত্তিক , তানভীর হোসাইন
এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম