মৃত্যুর প্রহর গুনছে তিস্তা
আসিফুর রহমান সাগর ও সহিদুল ইসলাম
তিস্তার নদীর পানির প্রবাহ দিনে দিনে অচিন্তনীয় অস্বাভাবিক মাত্রায় কমে আসছে। উজানে ভারতের বাঁধের বাধায় পানি প্রবাহ কমে আসায় তিস্তা সেচ প্রকল্প প্রতিবছর মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, এখন বর্ষার শুরুতে তিস্তার পানি প্রবাহ মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার কিউসেক এবং এ বছর শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ ছিল গড়ে মাত্র তিন হাজার কিউসেক। কিন্তু সরেজমিনে তিস্তা তীরবর্তী অঞ্চল ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কথারও সত্যতা মেলে না। কেননা এই বর্ষার শুরুতে তিস্তার বুকজুড়ে জেগে আছে ধু-ধু চর। মানুষ হেঁটে নদী পার হচ্ছেন।
ঐতিহাসিকভাবে তিস্তায় শুষ্ক মৌসুমে গড় পানি প্রবাহ ১০ থেকে ১৫ হাজার কিউসেক। কিন্তু ভারত গজালডোবায় বাঁধ নির্মাণ করার পর থেকে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীতে পানি প্রবাহ একেবারে কমে এসেছে। উজানের বাধায় প্রবাহ এভাবে দিন দিন কমে আসায় তিস্তা ধু-ধু বালুচরে পরিণত হতে শুরু করেছে। উজানে জেগে উঠেছে বিশাল বিশাল বালুচর। এভাবে পানি কমে আসায় তিস্তা ব্যারাজ সত্ত্বেও উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে প্রতিবছর বোরো আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোন বছরই সেচ প্রকল্পের পুরো এলাকায় পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয় না।
৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ খরস্রোতা তিস্তা নদী ভারতের সিকিম রাজ্যে উত্পত্তি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট দিয়ে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হয়েছে। বাংলাদেশে এর দৈর্ঘ্য ১শ’ ১২ কিলোমিটার। এটি শুধু স্বতন্ত্র একটি নদী মাত্র নয়, তিস্তা বাংলাদেশেরও নদী এবং তা ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহেরও অন্যতম উত্স। উজানে তিস্তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া মানেই ভাটিতে বাংলাদেশে তিস্তার অপমৃত্যু এবং সেইসঙ্গে ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনার প্রবাহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। এই নদীর অস্তিত্বের সঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ নির্ভরশীল। অথচ বর্তমানে তিস্তার অবস্থা দাঁড়িয়েছে মরা খালের মত। এখানে তিস্তায় ২০ হাজার কিউসেকের কম প্রবাহ হলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষিকাজে ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। গত কয়েকদিন ধরে তিস্তার নদীপাড় সংলগ্ন বির্িভন্ন গ্রামে ঘুরে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে পানি সংকটের কথা জানা যায়। তার বলছেন, বৃষ্টি যে বছর বেশি হয় সে বছর ঢলের পানি কিছুটা আসে। তবে গ্রীষ্মে নদীর স্রোত থাকে না একেবারেই। ফেব্রুয়ারি-মার্চে আবাদের মৌসুমে পানির হাহাকার সবচেয়ে বেশি। তখন নদী একেবারেই শুকনো, খটখটে।
তিস্তা ব্যারাজের নক্শা করা হয়েছে সাত লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে কৃষিকাজের লক্ষ্য নিয়ে। যার মধ্যে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে পানি সরবরাহ করা হবে। আর এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে এক লাখ ৫৪ হাজার ২৫০ হেক্টর এলাকায় পানি সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। অথচ পানির অভাবে প্রতি বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬৫-৭০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ দিতে পারছে না। পানির অভাবে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম শুরুই করা যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে পানি বিশেষজ্ঞ ও ওয়ারপো’র সাবেক মহাপরিচালক ম. ইনামুল হক বললেনঃ তিস্তায় এই শুষ্ক মৌসুমে সাধারণত ৪ হাজার ৫০০ কিউসেক থেকে ৫ হাজার কিউসেক পানি আসে। এই পানির ওপরেই আমাদের ওই অঞ্চলের মানুষের বোরো আবাদ নির্ভর করে। এখন পানি প্রবাহ কমে আসার মানে হচ্ছে, ভারত গজালডোবা ব্যারাজ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে খালের মাধ্যমে মহানন্দা নদী দিয়ে বিহারের মেতী নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে তিস্তার পানি অস্বাভাবিক কমে আসে। তিনি বলেন, সরকারের উচিত ভারতকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি করার বিষয়ে চাপ দেয়া। তা না হলে ভারত এভাবে পানি প্রত্যাহার করে যাবে। আর বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকার মানুষ ও দেশের কৃষি আবাদ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।
যৌথ নদী কমিশনের একজন মুখপাত্র ‘দৈনিক ইত্তেফাক’কে বলেনঃ ভারত ও বাংলাদেশ তিস্তা নদীকে অবলম্বন করে যে সেচ প্রকল্প করেছে তা দিয়ে পুরো প্রকল্পে পানি সরবরাহ করা সম্ভব নয়। তিস্তা নদী প্রবাহে এত পানি থাকে না। তবে তিস্তা চুক্তি হলে আমরা কতটুকু পানি পাবো এ বিষয়ে একটি পরিষ্কার ধারণা থাকবে। সেই মোতাবেক তখন আমরা সেচের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে পারবো। এখন কয়েক বছরের গড় পানিপ্রবাহ দেখে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক (১৯/০৬/২০১৩)