ওয়াইল্ড রিকশা চ্যালেঞ্জ ; বাঘের জন্য ভালোবাসা
সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে গবেষণা করে ওয়াইল্ড টিম। বাঘ রক্ষার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে এই সংস্থাটি। সম্প্রতি তারা আয়োজন করেছিল ওয়াইল্ড রিকশা চ্যালেঞ্জ। এতে অংশ নিয়েছিলেন দেশ-বিদেশের ২০ জন প্রতিযোগী। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মাহফুজ রহমান
পৃথিবীতে এখন বাঘের সংখ্যা কত? উত্তরটা ভীষণ মন খারাপ করার মতো—প্রায় তিন হাজারের বেশি! আর বাংলাদেশে এখন রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে কতটি? উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, সর্বসাকল্যে ৪৪০টি! অথচ ১০০ বছর আগেও সুন্দরবন ছিল আক্ষরিক অর্থেই বাঘের অভয়ারণ্য। কিন্তু এভাবেই কি দিন দিন বাঘ কমতে থাকবে? এটা নিশ্চিত, সচেতন কোনো মানুষই চান না চিড়িয়াখানায় মমি করে রাখা কোনো প্রাণীর নাম হোক রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
তেমনটা চান না বলেই পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে সাড়া দিয়েছিলেন ২০ জন প্রকৃতিপ্রেমী। ওয়াইল্ড টিমের ঘোষণার পরই তাঁরা ঠিক করেন, বাঘ রক্ষার জন্য রিকশা চ্যালেঞ্জে নামবেন। বাংলাদেশের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য থেকেও চালানো হয় ওয়াইল্ড রিকশা চ্যালেঞ্জে অংশ নেওয়ার প্রচারণা। অনলাইন ও বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে নাম নিবন্ধনের ঘোষণা শোনার পরই আগ্রহী ব্যক্তিরা শুরু করেন প্রস্তুতি নিতে। কেবল প্রস্তুতি তো নয়, বাঘ রক্ষার জন্য তহবিল সংগ্রহের বিষয়টিও ছিল তাঁদের মাথায়। তাই কেউ কেউ শুরু করলেন গিটার বাজাতে। কেউ হাতে তুলে নিলেন তুলি, ডিজাইন করলেন টি-শার্ট। সেগুলো বিক্রি করে সংগ্রহ করলেন তহবিল। এ ছাড়া ‘ইট কারি, সেভ টাইগার’ নামের উদ্যোগও নেওয়া হয় যুক্তরাজ্যে। এরপর? প্রতিযোগিরা সোজা উড়ে এলেন বাংলাদেশে। শুরু হলো রিকশায় চেপে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত থেকে সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন পাড়ি দেওয়ার চ্যালেঞ্জ।
১০ দিন, ২০ প্রতিযোগী, ৪০০ কিলোমিটার পথ
বাংলাদেশসহ মোট আটটি দেশের ২০ জন প্রকৃতিপ্রেমী নাম লেখান ওয়াইল্ড রিকশা চ্যালেঞ্জে। ২০ জনের ১০টি দল। রেজিস্ট্রেশনের সময় প্রতিটি দলের কাছ থেকে নেওয়া হয় রেজিস্ট্রেশন ফি। ওয়াইল্ড টিম জানায়, এই টাকার প্রায় পুরোটাই ব্যয় করা হবে বাঘ রক্ষার কাজে। এদিকে আগে থেকেই ঠিকঠাক ছিল ১০টি রিকশা। ঠিকঠাক ছিল যাত্রাপথের মানচিত্র। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি যাত্রা হলো শুরু। প্রতিযোগীদের একজন বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত এসভেন্ড ওলিং বললেন, ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়া কি বাংলাদেশকে কল্পনা করা যায়? যায় না। তাই বাঘ রক্ষার ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করতে কাজ করছে ওয়াইল্ড টিম। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য খুব চমৎকার একটি উদ্যোগ নিয়েছে এই সংস্থা। সেখানে যোগ দিতে পেরে এবং বাঘ রক্ষার জন্য কিছু করতে পেরে খুব ভালো লেগেছে।’
একবাক্যে নিজেদের উদ্যোগ সম্পর্কে বললেন ওয়াইল্ড টিমের পরিচালক লুসি, ‘আমার চাই বাঘ রক্ষা করতে, তাই আমরা নেমেছি বুনো প্রকৃতিতে!’
টেকনাফ থেকে সুন্দরবন
১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে রওনা হয়ে টেকনাফ। পৌঁছাতে পৌঁছাতে পরদিন সকাল। প্রতিটি দলকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো যার যার রিকশা। ছোটখাটো একটি অনুশীলন পর্ব হয়ে গেল এরই মধ্যে। ১৮ ফেব্রুয়ারি বেরিয়ে পড়লেন সবাই টেকনাফ থেকে। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত ঘেঁষে তাঁরা পাড়ি দিলেন ৫৫ কিলোমিটার পথ। পৌঁছালেন কক্সবাজারের মারমেইড ইকো রিসোর্টে। বিরতির ফাঁকে হলো সমুদ্রদর্শন। সেখান থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রামের চকরিয়া। ২২ ফেব্রুয়ারি বিরতি। পরের দিন আবার ৫৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে সবাই পা রাখলেন বরিশালে। সেখান থেকে পিরোজপুর। ২৫ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাট থেকে মংলা পৌঁছে ‘চ্যালেঞ্জ ফিনিশ’! আর শেষের দিন অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিযোগীদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সুন্দরবন ঘুরে দেখানোর জন্য। চ্যালেঞ্জ শেষের অনুভূতির কথা বলছিলেন কানাডার আলোকচিত্রী মাইকি লাং, ‘সারা জীবন মনে থাকবে এই চ্যালেঞ্জের কথা। বাঘ রক্ষার জন্য কিছু করতে পারার অনুভূতি সত্যিই দারুণ!’
সবশেষে সবাইকে দেওয়া হয় চ্যালেঞ্জে অংশ নেওয়ার সনদ ও স্মারক
ওয়াইল্ড টিম
ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ নামের বেসরকারি সংস্থাটির গোড়াপত্তন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম। ২০০৩ সালের কথা সেটি। পরে সংস্থাটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ওয়াইল্ড টিম। গোড়ার দিকে কেবল গবেষণাতেই সীমাবদ্ধ ছিল সংস্থাটির যাবতীয় কাজ। ২০০৭ সালে এসে বন বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হয় সংস্থাটি। শুরু হয় ‘টাইগার প্রজেক্ট’ গবেষণাকাজে যোগ দেন আয়ারল্যান্ডের বিশিষ্ট বাঘ-গবেষক অ্যাডাম বার্লো। তাঁর সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদে দায়িত্ব নেন ক্রিস্টিনা গ্রিনউড ও লুসি বদ্দাম ওয়েদ্দাম। সে বছরই ‘খাল সার্ভে’ শুরু করে সংস্থাটি। ভাটার সময় সুন্দরবনের খালে বাঘের ছাপ পর্যবেক্ষণ করে বাঘের আপেক্ষিক ঘনত্ব নির্ণয় করাকে বলা হয় খাল সার্ভে। এই গবেষণা দলে কাজ করছেন দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকজন গবেষক। গবেষণার পাশাপাশি সুন্দরবনের পাঁচটি জেলার ৭৬টি গ্রামে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। গ্রামবাসীকে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দল। ৬৫টি গ্রামে বাঘ রক্ষার জন্য কাজ করছেন গ্রামের এই স্বেচ্ছাসেবীরা। লোকালয়ে বাঘ চলে এলে বনের বাঘকে বনে ফিরিয়ে দেন দলের সদস্যরা। এ ছাড়া বাঘ না মারার ব্যাপারেও সচেষ্ট তাঁরা। ‘সুন্দরবন মায়ের মতো’—এমন স্লোগান নিয়েও সচেতনতা চালাচ্ছে ওয়াইল্ড টিম। সুন্দরবনের আশপাশের সব স্কুলপর্যায়ের শিশু থেকে শুরু করে গ্রামবাসীকে বোঝানো হচ্ছে, সুন্দরবন আমাদের মায়ের মতো। মা যেভাবে আমাদের রক্ষা করেন, সুন্দরবনও নানাভাবে রক্ষা করছে আমাদের। তাই সুন্দরবনকেও রক্ষা করতে হবে আমাদেরই। ওয়াইল্ড টিমের বাঘ রক্ষাবিষয়ক সচেতনতার একটি অংশ ছিল ওয়াইল্ড রিকশা চ্যালেঞ্জ।
২০ প্রতিযোগী
এসভেন্ড ওলিং (ডেনমার্ক), ক্রিস জোশেম (যুক্তরাষ্ট্র), কুইন কুয়াচ (অস্ট্রেলিয়া), ম্যাট ভিকারস (অস্ট্রেলিয়া), সারাহ-জেন-সল্টমার্শ (অস্ট্রেলিয়া) আরিফ মোহসিন (বাংলাদেশ), নাসিহা কাদের (বাংলাদেশ), অ্যাজবিয়ন অলিং (ডেনমার্ক), অ্যান ম্যারি সাইমনসেন (ডেনমার্ক), নেইল বিউসম্যান (জার্মানি), ফ্লোরিয়ান সুইটজেবেল (জার্মানি), আইলিন সালেহ (পাকিস্তান), রিচার্ড স্মিথ (যুক্তরাজ্য), ম্যাট ব্রুক (যুক্তরাজ্য), এড প্যাকশ (যুক্তরাজ্য), ফ্রেড ফিশলক (যুক্তরাজ্য), ন্যাথালি-অ্যান ডনজন (যুক্তরাজ্য), টম ম্যাসে (যুক্তরাজ্য), মাইকি লাং (কানাডা) ও লেই ম্যাকে (অস্ট্রেলিয়া)