ব্রাজিলের সেরাডো: উইপোকার ঢিবি যেন বাস্ততন্ত্রের ব্যাংক……

মাহবুব রেজওয়ান

ব্রাজিলের সেরাডো(Cerrado)। প্রকৃতি যেন তার সমস্ত রহস্যের ভাণ্ডার দিয়ে সাজিয়েছে ব্রাজিলের এই অঞ্চলটিকে। আফ্রিকাতে যেমন সাভানা(savanna)এক রহস্যের আধার , ব্রাজিলে তেমনি সেরাডো। আজ থেকে ১৮ কোটি বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকা একসাথে ছিল। এটি তখন পরিচিত ছিল গণ্ডয়ানা মহাভুমি নামে। প্রায় ১৫ কোটি বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকা একে অপর থেকে আলাদা হয়ে যায়। দুটি মহাদেশ আলাদা হতে লেগে যায় প্রাই সাড়ে ৩ কোটি বছরের মতো। আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিব ব্রাজিলের রুপ- রহস্যের আধার এবং প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের এক অপূর্ব উদাহরণ সেরাডো অঞ্চলের সাথে।

এই অঞ্চলটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। আর এই তৃণভূমিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে শয়ে শয়ে উইপোকার ঢিবি। এই উইপোকার ঢিবিই হচ্ছে এই অঞ্চলের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য এবং এই ঢিবিগুলোকে কেন্দ্র করেই বেঁচে আছে এই অঞ্চলের প্রাণিজগৎ। শুনতে হয়তো খুবই অদ্ভুত লাগছে! আসুন, পরিচিত হয় এই অঞ্চলের বাসিন্দা এবং তাদের জীবনযাত্রার সাথে। cerrado

উইপোকার ঢিবিগুলোই সেরাডো অঞ্চলকে আর সব অঞ্চল থেকে আলাদা করেছে। এখানে প্রতি একরে প্রায় ১৩০ টি করে উইপোকার ঢিবি রয়েছে। ঢিবিগুলো সাধারনত ২-৩ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। প্রতিটি ঢিবিতে অসংখ্য উইপোকা থাকে। যার প্রায় সবই কর্মী পুরুষ পোকা। প্রতিটি ঢিবিতে থাকে ১ টি করে বড় আকারের রানী উইপোকা। যার কাজ হচ্ছে ডিম দেয়া। একটি রানী উইপোকা প্রতিদিন প্রায় ১০,০০০ ডিম দিয়ে থাকে। ডিম দেয়ার পর ডিমগুলোকে ফেরমেন খাওয়ানোটাও রানী উইপোকার দায়িত্ব। এক একটি ঢিবি বানাতে প্রায় এক দশক লেগে যায়। এবারে আসা যাক, এই ঢিবিগুলোকে কেন্দ্র করে কিভাবে বেঁচে আছে এই এলাকার অন্যান্য প্রাণী সেই বিষয়ে।

দক্ষিণ আমেরিকার একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রাণী হল পিঁপড়াখেকো বা anteater। এরা প্রায় ৭ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। এদের ওজন সাধারনত ৩৬-৪০ কেজি।এদের পিছনে রয়েছে ডাইনিবুড়ির ঝারুর মতো একটি লম্বা লেজ। উইপোকার শক্ত ঢিবিগুলোকে ভাঙ্গার জন্য এদের আঙ্গুলে রয়েছে প্রায় ৬ ইঞ্চি লম্বা নখ। এদের লম্বা শক্তিশালী নখ দিয়ে এরা ঢিবিগুলোর একটি অংশ ভেঙ্গে ফেলে। সেই ভাঙ্গা অংশ দিয়ে এরা এদের সরু মুখ ঢুকিয়ে দেয়। এদের রয়েছে প্রায় ২ ফুট লম্বা জিহ্বা। যা দিয়ে এরা উইপোকা খেয়ে থাকে। এদের মুখ এবং জিহবার গঠন এমন, যেন তা তৈরিই হয়েছে উইপোকা বা পিঁপড়া খাওয়ার জন্য। পিঁপড়াখেকোরা প্রতি মিনিটে প্রায় ১৫০ বার জিহ্বা বের করতে  পারে। এরা প্রতিদিন ৩০,০০০ এর মতো উইপোকা খেয়ে থাকে। কিন্তু কখনই একটি ঢিবি থেকে খুব বেশি খায় না। এরা প্রতিদিন ৩০০ টির মতো ঢিবি থেকে উইপোকা খায়। একটি ঢিবিতে ৩ মিনিটের বেশি কখনই থাকে না। যেন ঘড়ি ধরে এই কাজটি করছে পিঁপড়াখেকোরা। অনেকগুলি ঢিবি থেকে উইপোকা খাওয়ার কারনে এবং উইপোকার উচ্চ প্রজনন হারের কারনে কখনই পিঁপড়াখেকোদের খাবারের অভাব হয় না। আর উইপোকাদেরও খুব বেশি ক্ষতি হয় না। একটি নিপুন সাম্যতা সবসময়ই বিরাজ করছে খাদক এবং খাদ্যের মাঝে। এছাড়াও, Armadillo  নামে একধরনের প্রাণী রয়েছে, এরাও উইপোকা খেয়ে থাকে। anteater

শুধু পিঁপড়াখেকো নয়, ফ্লিকার (Flicker) নামে একধরনের পাখি রয়েছে এই অঞ্চলে। এরাও উইপোকা খেয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, ফ্লিকার পাখিদের বাসাও হচ্ছে উইপোকার বাসায়। এরা উইপোকার ঢিবিতে ছোট গর্ত করে বাসা বানায়। যখন উইপোকারা এই বাসায় আক্রমন চালাতে চেষ্টা করে, তখন ফ্লিকার পাখিরা উইপোকাগুলিকে খেয়ে ফেলে। ফ্লিকার পাখি ছাড়াও এক ধরনের প্যাঁচা আছে এখানে। এরাও উইপোকা খায়। এই প্যাঁচাগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল দিনের বেলাতেও এদের দেখা মেলে।

এই অঞ্চলের আরেকটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রাণী হচ্ছে Maned Wolf। এই নেকড়েগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের লম্বা পা। যা এদেরকে লম্বা তৃণ বা ঘাস এড়িয়ে শিকারকে দেখতে সাহায্য করে। সাধারন নেকড়ের মতো এরাও ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকে। এই Maned Wolf দের নিয়ে আরেকটি মজার তথ্য হচ্ছে এরা লবেইরা (Lobeira) নামক একধরনের ফল খেয়ে থাকে। এই ফল অত্যন্ত তেঁতো হয়। এই অঞ্চলের নেকড়েগুলো একধরনের পোকার আক্রমনের শিকার হয়। যা মূলত, তাদের কিডনিতে আক্রমন করে। লবেইরা ফলের এমনই গুন, যার কারনে নেকড়েগুলো তাদের কিডনির সংক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। এই লবেইরা ফল জন্মে থাকে ছোট ছোট ঢিবির উপরে। Maned Wolf তাদের নিজস্ব সীমানা নির্ধারণের জন্য ঢিবির উপরে মল ত্যাগ করে থাকে।তাদের মলের সাথে লবেইরা ফলের বীজ বের হয়। আর এভাবেই নতুন করে জন্ম নেয় লবেইরা গাছ। অর্থাৎ, নিজেদের প্রয়োজনে Maned Wolf  নিজেরাই লবেইরা গাছের উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে। এটি যেন খাদ্য শৃঙ্খলের আরেকটি অসামান্য উদাহরণ এবং এখানেও উপস্থিত রয়েছে উইপোকার ঢিবি। wolf

বছরের ৬ মাস এখানে সম্পূর্ণ খরা থাকে। অক্টোবর মাসে আস্তে আস্তে আকাশে মেঘ জমে এবং বজ্রপাত হতে থাকে। তখন কিন্তু বৃষ্টি হয় না। দীর্ঘ ৬ মাস খরার কারনে এখানকার সবকিছু শুকনো খটখটে হয়ে যায়। এর কারনে দেখা যায় প্রায় প্রতি বছরই এখানে দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। বেশ কিছু প্রাণী হয়তো মারা যায়। কিন্তু, বেশিরভাগই বেঁচে যায় অথবা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। যুগ যুগ ধরেই এভাবে চলে আসছে। একধরনের বিষাক্ত সাপ রয়েছে ( Boa constrictor) যারা মাটির নিচে থেকে নিজেদের রক্ষা করে। ফ্লিকার পাখিরাও বেঁচে যায়। কারন তারা তাদের বাসা তৈরি করে উইপোকার বাসার মধ্যেই। এই দাবানলে উইপোকার বাসার তেমন কোন ক্ষতি হয় না। যুগ যুগ ধরে এভাবেই উইপোকার ঢিবিগুলো শত আঘাত সহ্য করে এখানে টিকে আছে। আর এখানকার গাছ অভিযোজিত হয়ে নিজেদের দেহে কর্কের একটি আবরণ তৈরি করে নিজেদের দাবানলের আগুন থেকে রক্ষা করে।

কিছুদিন পর নামে স্বস্তির বৃষ্টি। একটানা অনেকদিন বৃষ্টি হয় এখানে। আস্তে আস্তে আবারও তার হারানো রুপ ফিরে পেতে থাকে সেরাডো। এই সময় মাটির নিচ থেকে জেগে ওঠে একধরনের পিঁপড়া। যারা Leafcutter Ant নামে পরিচিত। নামের সাথে এদের কাজেও অনেক মিল। বৃষ্টির পর গাছে গাছে সবুজ পাতা জেগে ওঠে। এই পিঁপড়াগুলো দলে দলে গাছের পাতা কেটে নিয়ে একসারিতে হেঁটে যায়। সে এক অসাধারন দৃশ্য। পাতা নিয়ে এরা মাটির নিচে এদের আস্তানায় নিয়ে যায়। এখানে এরা ফাঙ্গাসের বাগান তৈরি করে। এই পাতাগুলো সেই ফাঙ্গাসকে খাওয়ায়। সেই ফাঙ্গাস থেকেই সব খাদ্য ও শক্তি সঞ্চয় করে Leafcutter Ant। এই পিঁপড়াগুলো অনেকসময় লবেইরা গাছের বীজও নিয়ে আসে ফাঙ্গাসকে খাওয়ানোর জন্য। সেই বীজ থেকে আবার জন্ম নেয় নতুন লবেইরা গাছ। যেই লবেইরা ফল আবার Maned Wolf দের অন্যতম একটি খাদ্য। pipra

ধীরে ধীরে রাত নামে সেরাডোর বুকে। কিন্তু  না, তবুও থেমে নেই এখানকার জীবন। উইপোকার ঢিবিতে একধরনের পোকা দেখা যায়। এরা ঢিবির বাইরের দিকে থাকে। এদের বলা হয় Headlight Beetle। এই নামকরনের কারন হচ্ছে এদের মাথার আলো। এদের মাথায় জোনাকি পোকার মতো আলো জ্বলে। সেরাডোর বুকে রাতের আঁধারে দেখলে মনে হয় উইপোকার ঢিবিগুলোকে কেউ যেন আলোকসজ্জায় সজ্জিত করে রেখেছে। এই দৃশ্যের যেন কোন তুলনা হয় না। কিন্তু, উইপোকার জন্য এটা কোন ভালো খবর নয়। কারন, এই আলোতে আকৃষ্ট হয়ে উইপোকা খুব কাছে চলে আসলেই Headlight Beetle এদের খেয়ে ফেলে। এভাবেই রাত পার হয়ে যায়। সুচনা হয় আরেকটি নতুন দিনের।

হাজার বছর ধরে এভাবেই উইপোকার ঢিবি রক্ষা করে চলেছে সেরাডো অঞ্চলের জীব বৈচিত্র্য। শত আঘাতের পরেও আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তারা। আস্তে আস্তে মানুষ নিজের প্রয়োজনে ব্যাবহার করছে এই অঞ্চলটি। ভুট্টা এবং সয়াবিন খুব ভাল উৎপন্ন হয় এখানে। তবুও মানুষের চাহিদার শেষ নেই। কেউ মানুষকে কিছু দিলে বিনিময়ে মানুষ তাকে কিছুই দেয় না। সেরাডোর এই অঞ্চল জীব বৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি প্রাকৃতিক ভারসাম্যও রক্ষা করে চলেছে। সেই সেরাডো আজ মানুষের কারণেই হুমকির মুখে।তবে আশার কথা এই যে, বর্তমানে এই অঞ্চলটিকে সংরক্ষণ করার বেশ কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সেরাডো আরও হাজার বছর টিকে থাকুক মাথা উঁচু করে, এটাই আমাদের কাম্য। তথ্য ও ছবি : ডিসকভারি ও ইন্টারনেট।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক

২৩/০৮/২০১৩

 

 

 

Related Articles

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics