স্বাদুপানির উড়ন্ত বাঘ!!
মাহবুব রেজওয়ান
জলের নিচের অজানা জগত নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। অজানা জলরাশির একদিকে যেমন রয়েছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। তেমনি আরেকদিকে রয়েছে রক্ত হিম করা অজানা দুঃস্বপ্ন। পানির নিচের ভয়াল দর্শন প্রাণীদের নিয়ে মানুষের আগ্রহ বহু দিনের। কতো যে কেচ্ছা-কাহিনী, রূপকথা, গল্প ছড়িয়ে আছে এমন প্রাণীদের নিয়ে! হলিউডের সিনেমা নির্মাতাদেরও যেন ঘুম হারাম হয়ে যায়। ‘পিরানহা’ সিনেমাটিই যেন তার প্রমাণ। ভয়ঙ্কর পিরানহা নিয়ে তো কম গল্প শুনিনি! ‘টাইগার ফিশ’ এর কথা ক’জন জানি!
এই মাছের নাম শুনলে প্রথমেই বাঘ মামার মুখখানি চোখে ভেসে ওঠে। কী ভয়ঙ্কর তীক্ষ্ণ আর ধারালো দাঁত বাঘ মামার! টাইগার ফিশের দাঁতগুলো দর্শন করলে আপনিও বলতে বাধ্য হবেন, ‘কথায় নয়, দর্শনেই পরিচয়’।
তীক্ষ্ণ, ধারালো দুই সারি দাঁতের জন্যই মূলত এই মাছের নামকরণ করা হয়েছে টাইগার ফিশ। এদের বাস আফ্রিকাতে এবং এরা এলেসটাইডি (Alestidae) পরিবারভুক্ত মাছ। এরা মূলত স্বাদুপানিতে বাস করে। সাধারনত হাইড্রোসাইনাস (Hydrocynus) গণের এলেসটাইডি পরিবারের বিভিন্ন প্রজাতির মাছকে টাইগার ফিশ বলে অভিহিত করা হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে ‘গোলিয়াত টাইগার ফিশ’ (goliath tigerfish)। আফ্রিকার কঙ্গো নদীর অববাহিকায় এদের উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। এছাড়াও লুয়ালাবা নদী এবং উপেম্বা ও টানগানয়িকা লেকে (Lake Upemba and Lake Tanganyika) এদের দেখা মেলে।
গোলিয়াত টাইগার ফিশ পাঁচ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে এবং এদের ওজন ১৫০ পাউন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে। যেন সাক্ষাৎ দানব! এদের পিঠের দিকটা অনেকটা জলপাই রঙের। আর পেটের কাছটায় রুপালী রঙের। কিন্তু আপনার যদি এদের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে, তবে এতো রঙের খেলা আপনার চোখে পড়বে না। যা প্রথমে চোখে পড়বে, তা হচ্ছে এদের দুই সারি ৩২টি ব্লেডের মতো ধারালো ও তীক্ষ্ণ দাঁত। যার একেকটি কম করে হলেও এক ইঞ্চি লম্বা! এই দাঁত দিয়ে যখন শিকারের গায়ে কামড় বসানো হয়, তখন আপনি বুঝতে পারবেন না এটি কোন মাছের কামড়ের ফল; নাকি কোন সামুরাইয়ের ধারালো তরোয়ালের কোপ! এদের ঠোঁট নেই বললেই চলে। দাঁতগুলো মুখের সামনের দিকের চোয়ালে সারিবদ্ধভাবে সাজানো। প্রাকৃতিকভাবে এরা ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
স্থানীয়দের মতে, এরাই একমাত্র মাছ যারা কুমিরকে থোড়াই কেয়ার করে! কোন পাত্তাই দেয় না আর কি! দিবেই বা কেন? যাদের নামের সাথে বাঘ মামার নাম জুড়ে গেছে, তাদের আর কিসের ঠেকা! ৬০ পাউন্ড ওজনের ক্যাটফিশকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলার রেকর্ডও রয়েছে গোলিয়াত টাইগার ফিশের। গোলিয়াত টাইগার ফিশ অধিক স্রোতের স্বাদুপানিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কারণ অধিক স্রোতধারায় অন্যান্য মাছ তেমন স্বাচ্ছন্দ্য নয়। এরা এদের শিকারের চারদিকে ঘুরতে থাকে। তারপর হঠাৎ করেই দুর্ভাগা শিকারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে।
তবে এদের শিকার জলের ছোট ছোট মাছ পর্যন্তই বিস্তৃত নয়। এদের শিকারের আওতায় ছোট ছোট পাখিও রয়েছে। নদীর অল্প পানিতে শিকারের আশায় বসে থাকা পাখি শুধু নয়; গবেষকরা দেখেছেন টাইগার ফিশ পানি থেকে শূন্যে লাফিয়ে উঠেও পাখি ধরে খায়। দক্ষিণ আফ্রিকার লিমপোপো প্রদেশে এক কৃত্তিম হ্রদে এমনই এক দৃশ্য ধারণ করেছেন একদল গবেষক। দক্ষিণ আফ্রিকার নর্থ-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিবেদনটি ‘ফিশ বায়োলজি’ সাময়িকীতেও প্রকাশিত হয়েছে।
শুধুমাত্র ভয়ঙ্কর দর্শন আর ভিন্নরকম শিকারের জন্যই গোলিয়াত টাইগার ফিশ বিখ্যাত নয়। জলজ বাস্তুতন্ত্রেও এরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক