সুন্দর লোপামুদ্রা

আ ন ম আমিনুর রহমান

ডিসেম্বর ২০১০-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) শেষ বর্ষ কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সফরে দেশময় ঘুরে বেড়াচ্ছি। ৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটি বাস টার্মিনালে এসে নামলাম শুভলং ও কাপ্তাই লেকে ঘুরব বলে। পাশের ফিশারি ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত বোটে উঠব। বোট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাই ক্যামেরা হাতে আশপাশটা একটু ঘুরে দেখছি। তখনই চোখে পড়ল। সন্তর্পণে পিছু নিলাম। উড়ে উড়ে গিয়ে বসল কাছেই একটি ঝোপের বুনো ফুলের ওপর। মনের আনন্দে মধু পান করছে। কালো, হলুদ, সাদা ও লাল রঙে মোড়ানো এই পতঙ্গটি ভারি সুন্দর। বাংলা নামটিও চমৎকার, ‘লোপামুদ্রা’।
লোপামুদ্রা এ দেশের সুন্দর ও বাহারি এক প্রজাপতি। ইংরেজি নাম Red-base Jezebel (রেড-বেস যেজেবেল) বহুদিন চেষ্টা করেও ওর বাংলা নাম জানতে পারিনি। অল্প কিছুদিন আগে অধ্যাপক শফিক হায়দার ও মনোয়ার হোসেনের ফিল্ড গাইড থেকে পেলাম, ওর নাম লোপামুদ্রা। Pieridae পরিবারভুক্ত এই প্রজাপতির বৈজ্ঞানিক নাম Delias pasithae pasithae বা Delias aglaia aglaia।2013-05-22-20-39-14-519d2cf2316f0-untitled-33
আমি এ পর্যন্ত মোট চার প্রজাতির যেজেবেলের ছবি তুলেছি। সাধারণ যেজেবেল বা ‘হরতনি’ দেশের সবখানে দেখা গেলেও লোপামুদ্রার দেখা মেলা ভার। কারণ, এরা মূলত বনবাসী। সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনে এদের দেখা মেলে। তবে আমি এদের যেমন রাঙামাটি, কাপ্তাই বা সিলেটে দেখেছি, তেমনি গাজীপুরের শালবন ও এর আশপাশেও দেখেছি।
লোপামুদ্রার আকার মাঝারি। প্রসারিত অবস্থায় পুরুষের ডানা ৬৮-৮৪ মিলিমিটার ও স্ত্রীর ৬৯-৯২ মিলিমিটার হয়। ডানায় কালো রঙের প্রাধান্য থাকায় প্রজাপতিটির সৌন্দর্য যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। পুরুষের সামনের ডানার ভিত্তি বা তলার রং কালো হলেও স্ত্রীর রং বাদামি-কালো। এই কালো বা বাদামি-কালোর ওপর ধূসর-সাদা রঙের কয়েকটি দাগ ও ফোঁটা দেখা যায়। অন্যদিকে, পেছনের ডানার মাঝের ও কিনারার কোষগুলো উজ্জ্বল হলুদ রঙের হলেও ডানার তলার বা গোড়ার দিকের কোষগুলো টকটকে লাল। লোপামুদ্রার সৌন্দর্য মূলত ডানার নিচের অংশেই; ওপরটা সে তুলনায় ফ্যাকাসে। ডানার ওপরের অংশের মূল রং কালো; তার ওপর বিভিন্ন আকারের ধূসর-সাদা টান। একমাত্র পেছনের ডানার নিচের দিকে দুই পাশে পেটের কাছে কয়েকটি হালকা লম্বাটে হলুদ টান রয়েছে, তার মধ্যে দুটো বেশ বড়। এদের শুঁড়, মাথা, বুক ও পেটের ওপরটা কালো এবং পেটের পাশ ও নিচটা ধূসর-সাদা।
জানুয়ারি-মার্চ এদের প্রজননকাল। স্ত্রী লোপামুদ্রা উপযুক্ত গাছের প্রতি পাতায় ১০-২০টি উজ্জ্বল হলুদ উপবৃত্তাকার ডিম পাড়ে। ডিমগুলো পাতার নিচের দিকে সমান্তরালে সাজানো থাকে। ডিম ফুটে লালচে-বাদামি শূককীট বের হয়। শূককীটের দেহের প্রতিটি খণ্ড বরাবর সমান্তরাল হলুদ ব্যান্ড রয়েছে, যাতে শক্ত চুল থাকে। বাইরের দিকের চুলগুলো কালো ও ভেতরের দিকেরগুলো হলুদ।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে লোপামুদ্রার দেখা পাওয়া যায়। এই ফুলের পরাগায়নে এরা সাহায্য করে। সুন্দর এই প্রজাপতিগুলোকে বাঁচাতে হলে আমাদের বন-জঙ্গল রক্ষা করতে হবে। তা করতে হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যই।

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো (২৩/০৫/২০১৩)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics