সঙ্কটে আলুরতলের শিয়াল; বিলুপ্তি যে কোন সময়।
রাহুল দাশ তালুকদার অভি
প্রাকৃতকি বৈচিত্র্যরে অপার লীলাভূমি সিলেটের আলুরতল। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ইকোর্পাকরে চারিদিকে সবুজ টিলা,ঝোপ ও জঙ্গলে রয়েছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী। এদের মধ্যে অন্যতম একটি প্রাণী শিয়াল। হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া…. দিনে দিনে অবাধ বিচরণক্ষেত্র কমে যাওয়ায় অতি ধূর্ত এই প্রাণীর ডাক এখন কালেভদ্রে শোনা যায়। এখন আর নিরাপদ নেই তারা। অথচ বাংলা সাহিত্যের অনেক এই গল্প আছে এই প্রাণীটিকে নিয়ে। গল্পে কত উপমা, কখনও পণ্ডিত কখনও মামা। কিন্তু বর্তমানে স্থাপনা নির্মাণ, জনসাধারনের অবাধ বিচরণ, জনবসতি গড়ে ওঠার কারনে তাদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
এক সময় আবাসিক সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সকালে ঘুম ভাঙতো শিয়ালের ডাকে। আর রাতের বেলাও শোনা যেত শিয়ালের ডাক। সকালে ও সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের সড়কগুলোতে চলতে দেখা যেত হরহামেশা। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে পরিবেশও পরিবর্তন হয়ে গেছে। বিনষ্ট হয়েছে এদের আবাস। ঝোপ-জঙ্গল নিধনের ফলে শিয়ালের সংখ্যা এখন খুবই কম। খুব বেশি শোনা যায় না সেই চিরায়ত হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া ডাকও।
প্রধানত দুই ধরনের শিয়াল পাওয়া যায় বাংলাদেশে। তাদের একটি পাতি শিয়াল অপরটি খেঁক শিয়াল। আলুরতলে যে শিয়াল পাওয়া যায় তা হলো পাতি শিয়াল বা Asiatic Golden Jackal যার বৈজ্ঞানিক নাম Canis aureus। বনের ভিতরে গর্ত করে সাধারণত এরা বসবাস করে। খাবারের সন্ধানে মাঝে মাঝে বাইরে আসলেও, আবার ফিরে যায় গর্তে। অনেকটা পোষা কুকুরের মতোই দেখতে পাতিশিয়ালের লেজটি নিচের দিকে নামানো থাকে। গাঁয়ের রং বাদামি, পিঠে ও পেছনের অংশে কালো লোম থাকে। নিশাচর প্রাণী হওয়াতে শিয়ালকে দিনের বেলা তেমন একটা দেখা যায়না, তবে কখনো ভোরের দিকে দেখা যায়। পেটে ক্ষুধা থাকলে দিনের বেলায়ও বের হয়। সন্ধ্যায় শিয়াল ডেকে ওঠে। দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝোপের ভেতর মাটির গর্তে লুকিয়ে পড়ে। সাধারনত ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চলে, তবে একাকীও ঘুড়তে দেখা যায়। এরা সর্বভূক। প্রধান খাবার পোকামাকড়, ইদুর, পাখি, ছোট আকারের মেরুদন্ডী প্রাণী, টিকটিকি, মৃতদেহ, শাকসবজি, আখের রস, ভূট্টা ইত্যাদি। এছাড়াও পাতি শিয়ালের খাবারের তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনা, মরদেহ ইত্যাদি। জানুয়ারির শেষ ও ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে পাতি শিয়ালের প্রজনন কাল। গর্ভকালীন সময় ৫৮ থেকে ৬৫ দিন। মাটির গর্তে বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চার সংখ্যা ৩ থেকে ৪ টি পর্যন্ত হতে পারে। দুধের পাশাপাশি মা তার বাচ্চার জন্য মুখে করে শিকার নিয়ে আসে। আবার আধা হজম খাবার বমি করেও বাচ্চাকে খেতে দেয়। ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত বাচ্চা দুধ পান করে। দুধ ছাড়ার পর বাচ্চারা নিজ জীবন শুরু করে। পুরুষ পাতি শিয়াল ১০ মাস বয়সে এবং স্ত্রী পাতি শিয়াল ১৮ মাস বয়সে প্রজননক্ষম হয়। পাতি শিয়াল প্রায় ১২ বছর বাঁচে। পাতি শিয়াল দেখতে অনেকটা হলদে লাল, কালচে ভাব। নাকের অগ্রভাগ কালো। দৈর্ঘ্যে ১০০ সেন্টিমিটার, দাঁড়ানো অবস্থায় উচ্চতা ৩৫ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৮ থেকে ১১ কেজি।
খাবারের অভাব দেখা দিলে শিয়াল লোকালয়ে হানা দেয় হাঁস-মুরগী ধরতে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমতে বর্ষার সময় শিয়ালের আনাগোনা বেড়ে যায় এবং তখনই মারা পড়ে বেশি। কারণ খাবারের জন্য তখন লোকালয়েই আসতেই হয় এদের। আর তখনই মানুষের হাতে নিরীহ এই প্রাণীর মৃত্যু ঘটে। সিলেটের বন কর্মকর্তা শাহাজাহান খান জানান, ‘‘ইকোর্পাকরে চম্পাবাগান ও বাঘমারা নামক স্থানটি শিয়ালের সবচেয়ে বড় অভয়ারণ্য কিন্তু মানুষের অবাধ বিচরন, গাড়ি আনাগোনা, মাটি কাটার ফলে আবাসস্থল হারাচ্ছে শিয়াল। ’’
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীঅধিকার সংরক্ষন বিষয়ক সংগঠন প্রাধিকারের উপদেষ্টা প্রফেসর ড. সায়েম উদ্দিন আহমেদ বলেন ‘‘অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে সিলেটে শিয়ালের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এছাড়া ইকোপার্ক ও সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের জঙ্গলগুলোতে ও শিয়াল তেমন একটা দেখা যায়না।অপ্রাপ্ত লতা পাতা ও মাটি কাটার ফলে শিয়ালের বাসস্থান আজ হুমকির মুখে। তিনি আরোও বলেন শিয়াল হারিয়ে গেলে ইকোর্পাকরে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে’’।