শব্দ দূষণ রোধের আইন এ যেন ‘‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই।’’
আতিকুর রহমান
শব্দর মাধ্যমেই রচিত হয় জীবনের ভিত্তিভূমি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ নানা ধরনের শব্দের সাথে পরিচিত হয়। আমারা শব্দের মাধ্যমে রাগ-অনুরাগ, আদর-আবদার, উপদেশ-নির্দেশ প্রকাশ করি যা নাকি একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনের জন্য শরীরে রক্ত সঞ্চালনের মতই প্রয়োজনীয়। এছাড়া বৃষ্টির টাপুর-টুপুর আওয়াজ, বনে-জঙ্গলে পাখির কিচির-মিচির শব্দ শুনতে কার না ভাল লাগে। শব্দের এই প্রয়োজনীয়, নিরীহ, সহনীয় ও রোমান্টিক রূপ সবসময় বজায় থাকলে কোন সমস্যা হত না। কিন্তুদিনের বেশীর ভাগ সময়ই আমরা অসহনীয় শব্দের সঙ্গে বসবাস করছি।
শব্দদূষণ রোধে ১৯৯৬ সাল থেকে আমেরিকার সংগঠন সেন্টার ফর হিয়ারিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন এর (বর্তমানে লিগ ফর দ্যা হার্ড অব হেয়ারিং) উদ্যোগে এপ্রিল মাসের যে কোন বুধবার দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস উদযাপিত হয়।Protect Their Hearing, Protect Their Health এই স্লোগানকে ধরে প্রতিবছর শব্দ সচেতনতা দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। যার বাংলা করা হয়েছে সুস্বাস্থ্যের জন্য শ্রবণশক্তি রক্ষা করা। এ দিবসটি পালন উপলক্ষ্যে লীগ ফর দা হার্ড অফ হেয়ারিং বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকে। তারা এ দিনে একমিনিট নিঃশব্দে থাকে। এছাড়া বিনামূল্যে কানের পরীক্ষা এবং শোনার যন্ত্রটি দিয়ে থাকে।
‘‘শব্দ’’ পরিবেশের কোন খারাপ উপাদান নয়। শব্দ জীবনযানপনের জন্য অপরিহার্য একটি উপাদান। প্রাণীর যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলো শব্দ। মানুষ কথা বলতে পারে বলেই সে অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে আলাদা। এই কথা বলার জন্য প্রয়োজন হয় শব্দের। যে মানুষ শব্দ শুনতে পারে না এবং কথা বলতে পারে না সে হাজার মানুষের মাঝে থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু শব্দ দূষণ পরিবেশের এক চরম বিরক্তিরকর উপাদান। পরিবেশ বিজ্ঞানী N. Manivasakam বলেন, ভৌত পরিবেশে সহনক্ষমতা বহির্ভূত অপেক্ষাকৃত উচ্চ-তীব্রতা সম্পন্ন শব্দের উপস্থিতিতে জীব-পরিবেশ তথা মানুষের উপর যে অসংশোধনযোগ্য ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়, সেই পরিবেশ সংক্রান্ত ঘটনাকে শব্দ দূষণ বলে।
প্রতিদিনই মানুষ বাড়ছে। নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্য স্থলে পৌঁছানোর তাগিদে মানুষ যানবাহন নির্ভর হয়ে পড়েছে । রাস্তায় নামছে নতুন গাড়ি। তৈরি হচ্ছে নতুন স্থাপনা। আর এই বাড়তি মানুষের চাহিদার জোগান দিতে বেড়েছে শব্দদূষণের মাত্রা। আবাসিক, অনাবাসিক এলাকা, অফিসপাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি হাসপাতালের আশপাশেও শব্দদূষণের তীব্রতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। স্কুল, হাসপাতালের সামনে লিখা থাকে, হর্ণ বাজাবেন ন্ াতবে কে শোনে কার কথা।
বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে শব্দ দূষণ হয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ডিজেল ও পেট্রোলচালিত ইঞ্জিন যেমন বাস, ট্রাক, লরি, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, টেম্পু ইত্যাদির হাইড্রোলিক হর্ন (৬০-৯০ ডেসিবল) রেলগাড়ির হুইসেল (৯০-১১০ ডেসিবল), পটকা, ডিজেল চালিত জেনারেটর (৮০ ডেসিবল), ঝগড়া বিবাদে পারস্পরিক উচ্চ স্বরে কথা বলার সময় (পুরুষের ১২০ হার্জ এবং নারীর ২৫০ হার্জ), মিছিল, মিটিং এ শ্লোগান, লাউড স্পিকার ও মাইকের মাধ্যমে (১১০ ডেসিবল), ( ঢোল ১০০ ডেসিবল), নিউজ পেপার প্রেস (১০০ ডেসিবল), রেডিও, টেলিভিশন, ক্যাসেট প্লেয়ার (৪৫-৮০ ডেসিবল), জেড বিমান ও সুপারসনিক বিমান (১৪০ ডেসিবল), বিভিন্ন নির্মাণ কাজে (৬০-৮০ ডেসিবল), লঞ্চ, ফেরি, স্টিমারের ভেঁপু (৮০ ডেসিবল), হোটেল, বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন ইত্যাদিতেও অযাচিতভাবে শব্দ দূষণ হয়ে থাকে।
ঢাকা শহরে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের হাইড্রোলিক হর্নের আওয়াজ শব্দ দূষণকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। শব্দ দূষণ এক মহামারি আকার ধারণ করেছে। শব্দ দূষণ রোধের জন্য অনেক আইন থাকলেও এ যেন ‘‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’’ এর বাস্তবরূপ। শব্দ দূষণ রোধের জন্য আমাদের দেশে আইনের কমতি নেই। কমতি রয়েছে প্রয়োগের। ২০০২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সংস্থা (বেলা) শব্দদূষণ বন্ধে আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে। ২০০২ সালের ২৭ মার্চ উচ্চ আদালত হাইড্রোলিক হর্ন এবং বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী যে কোন ধরনের হর্ন গাড়িতে সংযোজনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং গাড়িতে বাল্ব হর্ন সংযোজনের নির্দেশ প্রদান করে। এই আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে শাস্তির বিধানও প্রচলিত আছে।
এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬ এর ২৫, ২৭, ২৮ ধারামতে শব্দদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে অর্থদন্ড ও কারাদন্ড উভয়েরই বিধান রয়েছে। মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ১৩৯ এবং ১৪০ নং ধারায় নিষিদ্ধ হর্ন ব্যবহার ও আদেশ অমান্য করার শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড ও অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ক্ষমতাবলে সরকার শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ প্রণয়ন করে। বিধিমালার আওতায় নীরব এলাকায় ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ৫০ ডেসিবল এবং রাতে ৪০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ডেসিবল এবং রাতে ৪৫ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ডেসিবল ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবল ও রাতে ৬০ ডেসিবল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ডেসিবল ও রাতে ৭০ ডেসিবলের মধ্যে শব্দের মাত্রা থাকা বাঞ্ছনীয়। আইন থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণে দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে।
লসএঞ্জেলসের শব্দ বিজ্ঞানী ডা. ভার্ন ও নুভসেন এর ভাষায় ফিসফিস করে কথা বলার মধ্যে যে মাধুর্য ছিল তা আমরা হারাতে বসেছি। অন্তরঙ্গ আলাপ হয়ত ভবিষ্যতে হবে বিরাট হাকডাক করে। কুটনিপনা হবে উঁচু গ্রামে। শব্দহীনতা কখনোই জীবন সহায়ক নয়। শব্দহীন জীবন মৃত্যুর কাছাকাছি। কিন্তু এই শব্দই আজ শব্দ দানব হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। দূষিত করছে পরিবেশ। উৎকট শব্দে আমরা আজ পরিশ্রান্ত। একজন নিরপরাধ ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবে আর একজন গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে তাঁর শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দিবে এর জন্য তার কোন শাস্তি হবে না এটা হতে পারে না।
আমরা যারা শব্দদূষণের স্রষ্টা এবং যারা শিকার, সবাইই কিন্তু সাধারন নাগরিক। আমাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? এ দেশে নকল মহামারি রূপ ধারণ করার পর নকল তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে, পলিথিন বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে, রাজধানী থেকে থ্রি হুইলার তুলে দিয়ে পরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। সুতরাং এ দেশে শব্দ দূষণ রোধ সম্ভব হবে না এমন কথা দায়িত্বহীনতা ছাড়া আর কিছু নয়। ইস্রাফিলের শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার আশায় শুধু সরকারের দিকে না তাকিয়ে থেকে আসুন আমরা সবাই মিলে সচেতন হই। আসুন সবাই মিলে শব্দ দূষণ প্রতিরোধ করি।
কলামিস্ট
গড়পাড়া, মানিকগঞ্জ
onatiq88@yahoo.com