রহস্যঘেরা জাল…
স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস, ইংল্যান্ডের রাজা অ্যাডওয়ার্ডের সঙ্গে যুদ্ধে ছয়বার পরাজিত হয়ে একদিন হতাশমনে যুদ্ধচিন্তায় নিমগ্ন। এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন, একটি মাকড়সা জাল বুনতে চেষ্টা করছে। মাকড়সাটি পরপর ছয়বার ব্যর্থ হয়। তবুও সে নিরাশ না হয়ে চেষ্টা করতে উদ্যোগী হয় এবং সপ্তমবারে সফলকাম হয়। এটি দেখে রবার্ট ব্রুসের মন অদম্য উৎসাহে নেচে উঠল। তিনি আবার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ওই যুদ্ধে জয়লাভ করেন। ছাত্রজীবনে অধ্যবসায় রচনা পড়তে গিয়ে উদাহরণ হিসেবে মাকড়সার জাল বোনার এই কাহিনীটা বইয়ের পাতায় পড়ে বেশ ভালোই লাগত। আর এই জাল বুনতে গিয়ে তারা যে একবারেই জাল বুনতে সফল হয় না, বারবার অধ্যবসায় বা চেষ্টা করতে করতে সফল হয় তা কিন্তু আমরা তখন থেকেই জানতে পেরেছি এবং অধ্যবসায়ের ব্যাপারটাও সেই সময় থেকে সহজে মগজে ঢুকেছে। মাকড়সা যখন ঘোরে তখন একরকম রেশমের মতো সুতা বের হয়। আর এই সুতা থেকে তৈরি হয় জাল এবং এই জালে আটকা পড়ে মাকড়সার শিকার। মাকড়সার জালের সুতা অত্যন্ত মজবুত এবং প্রসারণযোগ্য, যদিও তা দেখে সহজে মনে হয় না। এই মাকড়সার জাল নিয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে আসছেন। তারা মনে করেন, এই মাকড়সার জালে রয়েছে এক রহস্যময় প্রযুক্তির ব্যবহার। আর তাদের কৌতূহলের প্রধান কারণ হলো, মাকড়সার জাল থেকে তৈরি রেশম কেন এত শক্ত হয়!
সম্প্রতি জার্মানির হাইডেলবার্গ ইনস্টিটিউট ফর থিওরিটিক্যাল স্টাডিজের প্রধান বিজ্ঞানী ড. ফ্রাউক গ্র্যাটার এবং তার দল মাকড়সার জালের রেশমের গোপন রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন অর্থাৎ মাকড়সা থেকে তৈরি রেশমের সূক্ষ্ম গঠন সম্পর্কে তারা জানতে পেরেছেন। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মাকড়সার দেহ থেকে যে রেশমের মতো তন্তু বা সুতা বের হয় তার কোনো সুনির্দিষ্ট আকৃতি নেই। এসব পদার্থ এমনিতে কাউকে চমকে দেওয়ার মতো নয়। তবে তারা যখন একসঙ্গে যুক্ত হয়ে রেশমের মতো সুতা তৈরি করে, তখন তা হয় ভীষণ শক্তিশালী। তারা দেখেছেন, মাকড়সার এই সুতা পারমাণবিক পর্যায়ে গঠিত। তারা এতে অণুর গঠনশীল কাঠামো সম্পর্কে বেশকিছু ধারণা পেয়েছেন। জানতে পেরেছেন, কীভাবে মাকড়সা বিস্ময়কর প্রযুক্তিতে এই সুতা তৈরি করে। ড. ফ্রাউক গ্র্যাটার বলেন, অনেকেই এই প্রাকৃতিক সুতার গঠনগত বৈশিষ্ট্য খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন। মাকড়সার জালের এমনিতেই যে শক্তি আছে তা ইস্পাতের মতো শক্ত। এটি টায়ারে ব্যবহৃত সিনথেটিক তন্তু কেভলারের চেয়েও শক্ত এবং অন্যদিকে এর ঘনত্ব সুতি বা নায়লনের চেয়ে কম। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মাকড়সার রেশম সুতায় মূলত দুটি প্রধান উপাদান রয়েছে_ একটি উপাদান নরম এবং এর কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই। অন্যটি শক্ত এবং অতি স্বচ্ছ বা পরিষ্কার। তারা দেখেছেন, এর নরম উপাদানটি রেশমের স্থিতিস্থাপকতায় কাজ করে এবং স্বচ্ছ উপাদানটি এই সুতাকে শক্ত করে তোলে। ফ্রাংকফুর্টের সেংকেনবার্গ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অ্যারাকনোলজি বিভাগেও মাকড়সা-জাতীয় প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। দলটির প্রধান পিটার ইয়েগার বলেন, তাদের এই গবেষণায় যে তথ্য পাওয়া গেছে তা মাকড়সার রেশম তৈরির রহস্য জানতে সাহায্য করছে এবং এই প্রযুক্তি খুব সহজেই সুতা তৈরির কারখানায় ব্যবহার করা যেতে পারে। শুধু তা-ই নয়, গবেষণায় পাওয়া তথ্য আরও অনেক কাজেও সহজে লাগাতে পারবেন বলেও আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।
জুনায়েদ তানভীর