রইল বাকি দুই
শরীফ খান
জানালার পাশের বয়সী একটি ডালিমগাছে যখন বাসা বাঁধতে শুরু করে এক জোড়া মুনিয়া পাখি, তখন থেকেই বাড়ির মালিক ইকবাল আহম্মদ খান ও তাঁর তিন সন্তান—সৃজন, রিজন ও কথা যেমন উল্লসিত হয়, তেমনি হয়ে ওঠে কৌতূহলী। হওয়ারই কথা। পুঁচকে পাখি দুটি ঠোঁটে করে লম্বা লম্বা ঘাস-পাতা নিয়ে দুলে দুলে উড়ে আসে মোহনীয় ভঙ্গিতে। মনে হয় যেন উড়ন্ত সাপ। তারপর সেই উপকরণ দিয়ে সুকৌশলে বাসা তৈরি করে নিপুণ কুশলতায়। ছেলেমেয়ে তিনটি জানালার পাশে বসে ওদের আসা-যাওয়া দেখে।
বাসাটি যখন গোলগাল ফুটবলের আকার ধারণ করল, তখন তো ওরা অবাক। ওমা! এই পুঁচকে পাখিদের এত বড় আর এত সুন্দর বাসা! তাদের কৌতূহল ক্রমেই বাড়ছিল—কবে ডিম পাড়বে, কবে হবে ছানা! ছানা পুষবে ওরা খাঁচায় পুরে। মা-বাবা ওদের বোঝান, পাখির ছানাদের পুষতে হয় না। ছানাদের ধরে আনলে মা-বাবা পাখিরা খুব কষ্ট পায়, কাঁদে।
একসময় বাসায় বড় বড় মুক্তোদানার মতো ছয়টি ডিম দেয় মা-পাখি। ১৩ দিনের মাথায় চারটি ছানা হয়। কী যে সুন্দর! মা ও বাবা-পাখি খাবার মুখে কতবার যে আসা-যাওয়া করে! বাসার ভেতরে ঢোকে, আবার বের হয়। জানালার পাশে বসে তিন ভাইবোন অবাক চোখে সে দৃশ্য দেখে। দিন গুনতে থাকে, কবে বেরোবে ছানারা বাসা থেকে!
হঠাৎ ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা। ছুটির দিন ছিল সেদিন। দস্যুর মতো ছুটে এল এক বড়সড় পাখি। ওটি হাঁড়িচাঁচা। কর্কশ চিৎকারে রীতিমতো যেন শোরগোল তুলে ফেলল। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল মুনিয়ার বাসাটির ওপর। পিচ্চি মুনিয়ার মা ও বাবা-পাখির তখন কী অসহায় অবস্থা। তারা করুণ স্বরে কাঁদে আর ছটফট করে উড়তে থাকে এগাছ-ওগাছ। ঘটনাটা এতই আকস্মিক ছিল যে ওরা তিন ভাইবোনও বুঝতে পারছিল না, কী করা যায়। এরই মধ্যে হাঁড়িচাঁচার আক্রমণে মুনিয়াদের বাসা প্রায় লন্ডভন্ড দশা। বাসা থেকে একটি ছানাকে ছোঁ দিয়ে নিয়ে উড়ে যায় হাঁড়িচাঁচাটি। মাটিতে পড়ে যায় তিনটি ছানা।
ইকবাল আহম্মদ দ্রুত ছানা তিনটিকে তুলে দেখতে পান, ওরা তেমন আহত হয়নি। ওদের আবার বাসায় তুলে দেন। বাসাটিও খানিকটা মেরামত করে দেন। বাসায় আরও দুটি ডিম ছিল। সেগুলো আর ফোটেনি। এর পর থেকে এক জোড়া হাঁড়িচাঁচা রোজই আনাগোনা করছিল মুনিয়া-ছানার লোভে। কিন্তু ইকবাল আহম্মদরা এবার সতর্ক ছিলেন। হাঁড়িচাঁচারা এলেই তাদের নানাভাবে তাড়িয়ে দিতেন। ফলে ওরা আর আক্রমণের সুযোগ পায়নি।
মুনিয়ার ছানা তিনটি বড় হতে থাকে। মাঝেমধ্যে বাসা থেকে বের হয়। কী সুন্দর পালক ফুটেছে ওদের শরীরে! কী মিষ্টি চেহারা। মা ও বাবা-পাখিরা পরম মমতায় খাবার তুলে দেয় ছানাদের মুখে! কিন্তু এল অন্য এক বিপদ। এক বিকেলে একটি বাদামি কাঠবিড়ালি এসে চোখের পলকে একটি ছানা মুখে পুরেই পালিয়ে গেল একছুটে। খুবই কষ্ট পেল ইকবালের পরিবার। ছানা দুটিকে রক্ষার জন্য ইকবালের পরিবার পালা করে পাহারার ব্যবস্থা করেছিল। পুঁচকে পাখিদের জন্য সবার বুকে জমেছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা।
রইল বাকি দুটি ছানা। ধীরে ধীরে ওরা বড় হলো। উড়তে শিখল। তারপর একদিন কোথায় যেন চলে গেল মা-বাবার সঙ্গে। ইকবাল পরিবারের জন্য রেখে গেল এক অমলিন মধুর স্মৃতি।
এ ঘটনাটি ঘটেছিল এ বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে। আখাউড়ার দেবগ্রাম এলাকায় বাড়ি ইকবাল আহম্মদ খানের। মুনিয়ার বাসাটি হওয়ার পর থেকেই তিনি আমার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছিলেন।
পাখিটি ছিল তিলা মুনিয়া। সারা দেশেই দেখা মেলে এদের। রাজধানী ঢাকা শহরেও আছে। বাসাও করে নিয়মিত। তবে খাঁচাবন্দী তিলা মুনিয়া ফেরি করে বিক্রি করে পাখি বিক্রেতারা। এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ রাজধানীতে এ দৃশ্য হরহামেশাই চোখে পড়ে।