যেমন দেখে এলাম আমাদের সুন্দরবন
সিফাত তাহজিবা
সুন্দরবন, পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা,বাগেরহাট জেলা এবং ভারতের কিছু অংশ নিয়ে প্রায় ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এই বনের রাজত্ব। সুন্দরী, গেওয়া, গরান, গোলপাতা থেকে শুরু করে বাইন, খালসি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ এই বনে জন্মে।এই বনে রয়েছে পাঁচশোয়ের অধিক প্রজাতির প্রাণীবৈচিত্র্য। গংগার পলল মাটিতে গড়ে উঠা এই বনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে মিশে আছে আরো কিছু নদী পশুর,শিবসা,রূপসা ও এর শাখা প্রশাখা।
প্রকৃতির এই অনন্য সৃষ্টি সুন্দরবনকে ঘিরে রয়েছ অনেক কাহিনী, সুন্দরবনের উপর লেখা হয়েছে অনেক বই। তবে সবগুলোর মাঝেই জ্ব্ল জ্ব্ল করছে এ বনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা স্থানীয়রা যাকে বাঘ মামা বলে চেনে ! বনের গার্ড থেকে শুরু করে জেলে,মাঝি প্রায় সবার কাছেই এই বাঘ মামাকে নিয়ে আছে ছোটখাট অনেক গল্প ! এমনকি বিখ্যাত শিকারী জীম করবেট’র ( Jim Corbett) অনেক বইতেও আছে সুন্দরবনের এই বাঘের কথা। যেমন রাজকীয় তার চালচলন, শিকারেও তেমনি হিংস্র ! সুন্দরবনে বাঘের দেখা পাওয়া খুবই কঠিন কিন্তু অনেক বৈচিত্র্যময় পাখির দেখা মিলবে সুন্দরবনে, সাথে বন্য শূকর, বক, শুশুক, কুমির , বানর, হরিণের ও দেখা মেলে মাঝে মাঝে !
তো এতো গুণের আর সৌন্দর্যের যে বন তা কি আর না দেখে থাকা যায়??!!! তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের ৩য় বর্ষের আমরা ৬৩ টি জন ঘুড়ে এলাম বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষিত সুন্দরবন। শীতের শেষে এ ট্যুরে আমদের সাথে ছিলেন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আমিনুর রহমান মজুমদার স্যার আরও ছিলেন আমদের সবার প্রিয় ড. নাদিরুজ্জামান মণ্ডল স্যার ও ড. রামেশ্বর মণ্ডল স্যার। গত ২রা ফেব্রুয়ারী থেকে ৭ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত আমরা ছিলাম শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে স্নিগ্ধ এক মায়াবী প্রকৃতির সংস্পর্শে।
সাইন্স ক্যাফেটেরীয়ার গেট থেকে দুপুর ১২টায় বিশাল এক বাসে করে শুরু হল আমাদের যাত্রা,সবাই খুজে খুজে নিজের প্রিয় বন্ধুদের সাথে বসেছে। আমার মত অনেকেই আবার দেরী করে ফেলায় অন্য সীটে বসছে অগত্যা আমিও বসলাম আমাদের ফার্স্ট গার্ল সুমাইয়ার পাশে! স্বর্ণা, ইতি, মনিজা, আর মৌটুসী সবার মনেই চাপা উত্তেজনা, কারণ বেশিরভাগের এটাই প্রথম সুন্দরবন দেখতে যাওয়া। পেছন থেকে ভেসে আসছে ‘ চল না ঘুরে আসি……’ এমন অনেক গান, বাসে অনেক মজা করে ক্লান্র হয়ে সবাই যখন ঘুমে ঢুলছিলাম তখন রাত প্রায় ৯টা! হঠাৎ একজন বলে উঠল ‘এসে গেছি’!
না, সুন্দরবন না আমরা পৌঁছলাম খুলনা লঞ্চ টার্মিনালে, লঞ্চে উঠেই আবারও ছোটাছুটি করে রুম খোঁজা শুরু হলো যেন বন্ধুরা সবাই একসাথে থাকতে পারি! ভোর ৪টায় শুরু হল আমদের লঞ্চে করে কুয়াশা মিশ্রিত রূপসা নদী দিয়ে মূল যাত্রা সুন্দরবন অভিমূখে !
৬:৩০টায় করমজল এসে থামল লঞ্চ। লঞ্চের ডেকে দাড়িয়ে সুন্দরবনের প্রভাতের সূর্যস্নান আর প্রকৃতি অপার মাধুর্য উপভোগে ব্যস্ত অনেকেই ! দেখছি সুন্দরবনের করমজল। সামনে নদীতে ভাসছে ছোট জাহাজ যেগুলো দিয়ে মংলা বন্দরে নানা বাণিজ্যিক মালামাল খালাস করা হয়। এগুলোকে বলা হয় লাইটার শিপ। এরপর সবাই মিলে একসাথে নাস্তা করে হুড়োহূড়ি করে নৌকায় উঠলাম উদ্দেশ্য, চাদপাই রেঞ্জের অন্তর্ভূক্ত করমজল, এর মধ্যে একটি বন্য প্রাণী (কুমির,হরিণ,বানর)প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে, দু;পাশে বনের গাছগাছালি মাঝেকাঠের পাটাতনে খট খট আওয়াজ তুলে আমারা এগিয়ে চলছি, এখানে আইলা ঝড়ের সময় সমুদ্রের ঢেউ এসে পড়েছিল তারই চিহ্ন পড়ে আছে পুরো পথজুড়ে। পথিমধ্যে দেখা মিলল কিছু বানরের! কৌতুহলী দৃষ্টিতে দেখছিল আমাদের! সকালে হিম শীতল পরিবেশ খুব দ্রুতই পাল্টে গেল, গরমে আমাদের কিছুটা স্বস্তি দিল করমজলের কয়েকটা চিত্রা হরিণ, আমাদের দেখেই মাথা এগিয়ে দিল, অদ্ভুত এক ধরণের মায়া অনুভব করলাম, এর মধ্যে অতি উৎসাহী আসিফ,সাদিদ, অনিক বানরকে দিল কোলড্রিংস সেটা পেয়ে সাথে সাথেই চুমুক বসালো বানর আর কোলড্রিন্স এর মজা পেয়ে বানরের সেকি লাফালাফি !!
করমজল থেকে ঘুরে আমরা হারবাড়িয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র এসে পৌঁছালাম সেখানে উল্লেখ্যযোগ্য বলতে অনেকগুলো লাল কাঁকড়া পথের দু’ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
সারাদিন ঘুরে পরিশ্রান্ত সবাই পরদিন খুব ভোরে উঠে জানতে পারলাম আমরা কচিখালী এসে পড়েছি ! সবার মধ্যেই চাঞ্চল্য দেখা দিল, আজকে বনের গভীরে যাওয়া হবে কারণ কচিখালীতে খুব ভোরে হরিণ দেখতে পাওয়াযায় ! সাথে ২জন গার্ড ছিলেন বলা তো যায় না, যদি বাঘ মামা স্বয়ং হাজির হয়ে যান। একসময় সুন্দরবন এ লঞ্চ, স্পিড বোর্ড , নৌকা থেকেও ঝাকে ঝাকে হরিণ দেখতে পাওয়া যেতো, কিন্ত পরিবেশের অনেক বিরূপ পরিবর্তনের ফলে হরিণ এখন বিপন্ন প্রাণীদের তালিকায়!
অনেক দূর থেকে দেখা মিলল মাত্র ২টি হরিণের। এর মধ্যেই একজন ফরেস্ট গার্ড তার জীবনে ঠিক এই জায়গায় ২০০৩ কি ২০০৫ সালে বাঘ দেখার কাহিনী বললেন। সবাই তখন আসেপাশে খুব সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে যদি একটিবারের জন্য হলেও বাঘ দেখা যায়! মাটিতে বাঘের পায়ের ছাপ খুজতে খুজতে দুপাশে টাইগার ফার্ন( শিকারের সময় বাঘ যে সব বড় বড় ঘাস আকৃতির ফার্নের পিছনে লুকিয়ে থাকে ) ধরলাম,বেশ কয়েকটি বরই আর খেজুর গাছ চোখে পরল, শেষ মুহূর্তে ৪,৫ টি বন্য শূকরের দেখা পেলাম আমরা! মাঝখানে সরু আকাবাকা পথ ধরে আবার ফিয়ে আসলাম নৌকা করে লঞ্চে। লঞ্চ থেকে নৌকায় উঠা-নামা ছিল অনেকের কাছে হিমালয় পাড়ি দেবার মতো কঠিন সেগুলো আবার কয়েকজন ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করতেও ভুল করেনি! বনের মধ্য দিয়ে প্রায় ১০-১৫ মিনিট হাটলাম মাঝ পথে শোনা যাচ্ছিল সনুদ্রের শো, শো শন্দ দেখা মিললো জামতলী সমুদ্র সৈকত, সবার সেকি উল্লাস! যেনো নতুন সমুদ্র সৈকত আবিষ্কার করে ফেলেছি আমরা! ছবি তোলা চলছে সবারই সমান তালে,সূর্যাস্ত দেখলাম সবার সাথে !
এরপর কটকা রেঞ্জে, সবাই দম আটকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষণ পর বেশ কিছু হরিণ এসে আমাদের একদম কাছ থেকে পাতা খাচ্ছিল! সুন্দরবনের সায়াহ্ণের ম্রিয়মান আলোতে হরিণগুলোও যেনো আরও মায়াবী হয়ে উঠেছিল! কিন্তু সব জায়গাতেই সিডর,আইলার আঘাতে মুমূর্ষ আমদের প্রিয় সুন্দরবন। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে শত শত গাছ!সমুদ্রের ঢেউয়ের উন্মাদনায় বনের কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত পানি এসে পড়েছে,ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অনেক বৃক্ষরাজি। ঢেউগুলো আছরে পড়ছে,পাড় ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছে সমুদ্র গহবরে ।
৩য় দিন পা রাখলাম দুবলার চরে। এখানেই গেলাম আমরা শুটকী পল্লীতে! এই প্রথম জেলেদের জীবন দেখার সৌভাগ্য হলো সবার। বাতসে ভেসে বেড়াচ্ছে শুটকীর গন্ধ! সমুদ্রের মাছগুলোকে কড়া রোদে শুকিয়ে শুটকি করা হয। সুন্দরবনের লাবণ্যে একদিকে যেমন সবাই মুগ্ধ তেমনি পাশাপাশি নিষ্ঠুর পরিবেশ বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে অসচেতনভাবে মাছ আহোরণের ফলে জালে আটকা পড়ে কিভাবে প্রাণ হারায় সামুদ্রিক মা কচ্ছপ। চরে পরে আছে মৃত কচ্ছপ, জেলীফিস !
জেলেদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল, এরা কেউই এখানে স্থায়ীভাবে থাকেনা, কারো বাড়ি বাগেরহাট আবার কারো পটুয়াখালী ! বছরে ৫,৬ মাস শীতের এই মৌসুমটায় ওরা এখানে এসে অস্থায়ী ভাবে থাকে, কারো পরিবার ই এখানে থাকেনা, কারণ হিসেবে বলল খুবই বিপদজনক পরিবেশের কথা, যেকোন মুহূর্তে সমুদ্রে বিলীন হবার ভয় সাথে বন্য প্রানীর উপদ্রবতো আছেই। সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হলো বিশুদ্ধ খাবার পানির।
বিকেলে হিরণ পয়েন্ট থেকে টাইগার পয়েন্ট ঘুরে হিরণ পয়েন্টে আমরা রাত ৯টা পর্যন্ত ছিলাম,বন বিভাগের একটি রেস্ট হাউস রয়েছে সেখানে। ২টি পুকুর আছে, একটি খাবার পানির অন্যটিতে স্থানীয় গার্ড,ট্যুরিস্টদের ব্যবহারের জন্য। আমরা যে সময়টিতে গিয়েছিলাম সেটি হলো বাঘের প্রজনন ঋতু। ফরেস্ট গার্ডরা আমাদের আরো ভীতিকর খবর শুনালেন যে, তারা বেশ ২,৩ দিন ধরেই এখানে বাঘের গর্জন শুনতে পাচ্ছেন। বাঘিনী যখন বাঘের কাছ থেকে কিছুটা দূরে চলে যায় তখনই বাঘ গর্জন করতে ডাকতে থাকে! এমনকি এই ঋতুতে তারা এখানে বাঘ দেখতেও পেয়েছেন!টাইগার পয়েন্টে যাওয়ার পথিমধ্যে অজস্র হরিণের পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম আমরা। টাইগার পয়েন্টে পেলাম বাঘেরও পায়ের ছাপ!! জায়গাটি পুরোটি জুড়ে আছে টাইগার ফার্ণ! বাঘের জন্য আদর্শ শিকারের স্থান।
এরপর টাইগার পয়েন্ট থেকে আমরা নেভীর একটি কোয়ার্টারের ভিতর দিয়ে বের হলাম এবং ফিরে আসলাম হিরণ পয়েন্টে, রেস্ট হাউসটির থেকে প্রায় ১২-১২ কদম দূরে আমাদের দৃষ্টি পড়ল মাটিতে একটি জায়গা থেকে বুদবুদ সহকারে পানি বের হচ্ছে। গার্ডরা আমদের জানালেন বেশ কয়েক মাস ধরেই এটি হচ্ছে! আর পানির সাথে বের হচ্ছে গ্যাস! প্রাকৃতিক গ্যাস! ম্যাচ নিয়ে আগুন জালানো হল,আগুন পানির মিশ্রণ আমরা অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করলাম! পরক্ষণেই ভাবতে বসলাম এভাবে কত পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস আর পানি অপচয় হচ্ছে!! হিরণ পয়েন্টে আমরা রাত ৯টাপর্যন্ত ছিলাম, সেখানে পাতা বিছিয়ে রাখা হয়েছিল হরিণ আসবার জন্যে , হরিণএলো ঠিকই কিন্তু হরিণের গন্ধ পেয়ে বাঘ মামার আগমণ রাতের অন্ধকারে ঘটেছিল,বাঘের অভয়াবণ্য ঘোষিত এলাকায় বাঘ আসবে না তা কি হ্য়! বাঘ মামার আগমণ রাতের অন্ধকারে ঘটেছিল এবং গার্ডরা আমাদের সতর্ক করে দেন যেনো কেউ আলাদা না থাকে! বাঘের দেখা না পেলেও রোমাঞ্চকর এ অভিজ্ঞতা হয়তো কোনদিনও ভোলা যাবেনা!
চতুর্থ দিন বঙ্গোপসাগর হয়ে আমরা মংলা সমুদ্র বন্দরে নামলাম।সামনে নদীতে ভাসছে ছোট জাহাজ যেগুলো দিয়ে মংলা বন্দরেনানা বাণিজ্যিক মালামাল খালাস করা হয়। এগুলোকে বলা হয় লাইটার শিপ।সমুদ্রে অগণিত জেলী ফিস দেখতে পেলাম সাথে কয়েকটি শুশুক! এরপর বিদায় নেবার পালা সুন্দরবনের কাছ থেকে। আমাদের একমাত্র ম্যাংগ্রোভ বন সুন্দরবনের সৌন্দর্যে অভিভূত ছিলাম ৫টি দিন, ফিরে আসার সময় যতই ঘনিয়ে আসছিল ততই যেন একটা অব্যক্ত কষ্ট মনের মাঝে চেপে বসছিল। কিছু কিছু জায়গায় সুন্দরবনের এমন অর্ধমৃত চিত্র দেখতে হবে তা কখনই ভাবি নি।এর পেছনে কারণ হিসেবে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা,সমুদ্রপৃষ্ঠ’র উচ্চতা বেড়ে যাওয়া সহ অনেক প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
ঘূর্ণিঝড়, জ্বলোচ্ছাস আর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ থেকে সুন্দরবন আমাদের এই ছোট্ট দেশটিকে আগলে রেখেছে। সুন্দরবনের দৃশ্যপট আজীবন মনের মাঝে গেথে থাকবে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা, গর্জন, সবকিছুই হয়তো আগের মতনই থাকবে কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে হয়তো একদিন এই সুন্দরবন কেবল গল্প,কবিতা আর পাঠ্যপুস্তকেই সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে! এই সুন্দরবন আমরা দ্বিতীয়টি আর কোথাও পাবোনা।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনেক ধন্যবাদ সুন্দরবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
বাংলাদেশের প্রকৃতি নিয়ে আমার একটা ব্লগ আছে। এখানেও অনেক কিছু জানতে পারবেন।