মেঘনার অব্যাহত ভাঙ্গনে হাতিয়ার মূল ভূখন্ড হারিয়ে যাচ্ছে
আনোয়ারুল হক আনোয়ার নোয়াখালী ব্যুরো থেকে : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি তৎসহ শস্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত মেঘনা বেষ্টিত হাতিয়া মূল দ্বীপ এখন স্বীয় অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। মেঘনার অব্যাহত ভাঙ্গনে দ্বীপটি নানাবিধ ঐতিহ্য হারিয়ে এখন নিজের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত। ১৯৭৪ সালের দিকে হাতিয়া পুরাতন শহর নদীগর্ভে বিলীন হয়। একই সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বিভিন্ন নিদর্শন এবং ঐতিহ্যবাহী হাতিয়া জামে মসজিদ এখন শুধু ইতিহাস। অব্যাহত মেঘনার ভাঙ্গনে শত শত কোটি টাকার সম্পদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মাঠের পর মাঠ ফসলী জমি, ঘরবাড়ী সবকিছু। গৃহহীন হয়েছে ৭০ হাজার পরিবার। আশ্রয়ের খোঁজে নিজ জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাযাবরের ন্যায় বসবাস করছে হাজার হাজার পরিবার। এক সময় যাদের ধন সম্পদ প্রভাব প্রতিপত্তি সব ছিল। তারাও মেঘনার ভাঙ্গনে রাতারাতি পথের ভিখেরীতে পরিণত হয়েছে। যাদের শত শত বিঘা জমি ছিল-তারা এখন বেড়ী বাঁধ, সাইক্লোন শেল্টার কিংবা জেগে ওঠা নতুন চরে চরম ঝুঁকির মধ্যে দিনযাপন করছে।
বিভিন্ন তথ্যে জানা গেছে, ষাটের দশকে নোয়াখালীর মূল ভূখ- থেকে হাতিয়া দ্বীপের মধ্যবর্তী স্থানে সরু একটি খাল প্রবাহিত ছিল। কিন্তু এরপর ভাঙ্গন শুরু হয়। এরপর হাতিয়া নতুন শহর অর্থাৎ হরনী, চানন্দী ইউনিয়ন কয়েক বছরের মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়। এরপর নলচিরা ও সুখচর ইউনিয়নও মাত্র কয়েক বছরের ৯০ শতাংশ হারিয়ে যায়। হাতিয়া দ্বীপের উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী আফাজিয়া বাজারটি আগামী এক বছরের মধ্যে বিলীন হবার আশংকা করছে এলাকাবাসী। দ্বীপটির উত্তর ও পূর্বাংশ বিলীন হবার পাশাপাশি পশ্চিম পার্শ্বের বিস্তীর্ণ এলাকা ইতিমধ্যে মেঘনায় হারিয়ে গেছে। তন্মধ্যে চরকিং, সুখচর, তমরদ্দি ও সোনাদিয়া ইউনিয়নের পশ্চিমাংশের বিশাল এলাকা মেঘনা কেড়ে নিয়েছে। হাতিয়ার প্রধান ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত তমরদ্দি বাজারের ৭০ শতাংশ এলাকা ভেঙ্গে গেছে। আগামী পাঁচ বছরে তিনটি ইউনিয়নের আরো বিশাল এলাকা হারিয়ে যাবার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। হাতিয়া উপজেলার কয়েকজন প্রবীন অধিবাসীর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭০ সালের দিকে মূল ভূখ-ের আয়তন ছিল ৩৮০ বর্গ কিলোমিটার। অর্থাৎ বিগত তিন দশকের অধিক সময়ে ১৮০ বর্গ কিলোমিটার জনপদ মেঘনার করাল গ্রাসে বিলীন হয়েছে।
হাতিয়া মূল ভূখ- নদী ভাঙ্গন রোধ কল্পে দুই দশক পূর্বে নেদারল্যান্ডের একটি বিশষজ্ঞ দল দ্বীপটি পরিদর্শন করেন। কিন্তু এরপর আর কিছু জানা যায়নি। বিগত আশির দশকে হাতিয়ার সাবেক মন্ত্রী মরহুম আমিরুল ইসলাম কালাম এর উদ্যোগে উত্তরাঞ্চলে মেঘনায় পরিত্যক্ত রেলের বগি, পাথর ও মাটি ভর্তি হাজার হাজার ব্যাগ নদীতে ফেলা হয়। সে সময় জোয়ারের তীব্র স্রোতে উদ্যোগটি ব্যাহত হয়। এরপর স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে এযাবত ভাঙ্গন রোধ কল্পে বেড়ীঁ বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু মেঘনার হিংস্রতা রোধ করা সম্ভব হয়নি। অভিযোগে প্রকাশ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বেড়ীবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য যে পরিমান অর্থ ব্যয় করা হয়। তার সিংহভাগ সংশ্লিষ্ট বিভাগ, স্থানীয় জন প্রতিনিধি, প্রকল্প চেয়ারম্যান ও সদস্যরা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। অবশিষ্ট অর্থে দায়সারাগোছের কাজ করা হয়। আর এতে করে সামান্য জোয়ারের তোড়ে বেড়ীবাঁধ পুনরায় বিধ্বস্ত হয়। এভাবে চলছে মেঘনার ভাঙ্গন থেকে হাতিয়াদ্বীপ রক্ষার উদ্যোগ। অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে সমুদ্রের লবণাক্ত জোয়ারের পানি থেকে হাতিয়া দ্বীপের হাজার হাজার একর জমির ফসল রক্ষা কল্পে জরুরী ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণের জন্য তাৎক্ষণিক অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু উক্ত প্রকল্পের ৭০ শতাংশ অর্থ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা হাতিয়ে নেয়। অর্থাৎ প্রতিটি কাজে লুটপাটের মহোৎসব পরিলক্ষিত হয়।
সূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব (০১/০৭/২০১৩)