মৃত্তিকার পতনেই কি সভ্যতার পতন !!!!
মানব সভ্যতার বিকাশ আজথেকে মোটামুটি দশহাজার বছর আগে থেকে ধরা হয়ে থাকে, এখানে বিকাশ বলতে কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে ধরা হয়ে থাকে,তবে মানুষ আজন্ম নিজেকে ভেঙেচুড়ে আবার গড়ে একে একে সভ্যতার বিকাশকে তরান্বিত করেছে।নানা সময়ে এর ভিত্তি হয়েছে মাটি বা মৃত্তিকা। সভ্যতার উৎপত্তি আর বিকাশ নিয়ে এক চিত্তাকর্ষক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে গতকিছুদিন আগেই, যাতে বলা হচ্ছে, ঐতিহাসিক সভ্যতাগুলোর নিপতিত হওয়ার পেছনে অন্যতম যে কারণটি প্রাধান্য পেয়েছে তা হল- যে মাটিতে সভ্যতাগুলোর উৎপত্তি হয়েছে, তারা সেই মাটির ক্ষয়রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে । আধুনিক বিশ্বকেও হয়তো এমন পরিনতি বরণ করতে হতে পারে।
অধ্যাপক ম্যারি স্কোলস এবং বব স্কোলস সায়েন্স নামক একটি সাময়িকী তে প্রকাশ করেন যে,কিভাবে অনেক জমির উর্বরতা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে শুধুমাত্র ভূমিক্ষয় , লবণাক্ততা জমে , এবং পুষ্টির হ্রাসের ফলে।
উইটস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানি,উদ্ভিদ এবং পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ম্যারি স্কোলস এর মতে, “ ক্রমাগত মাটি চাষ অত্যন্ত দীর্ঘসময়ের জন্য হলে তা কৌশলে, জৈবপদার্থকে পুষ্টিতে রূপান্তরকারী উপকারী ব্যাকটেরিয়াসমূহ ধ্বংস করে দেয়”।যদিও উন্নত প্রযুক্তি যেমন – সার, সেচ , এবং চাষ এর উচ্চ ব্যবহার- একটি মিথ্যা নিরাপত্তা ধারণা প্রদান করে যে এদের ব্যাপক ব্যাবহার ভূমিক্ষয় রোধ করে, কিন্তু বাস্তবে বিশ্বব্যাপী চাষযোগ্য জমির প্রায় ১ % প্রতি বছর পতিত হিসেবে গণ্য হচ্ছে। আফ্রিকা, যেখানে ভবিষ্যতে কৃষিক্ষেত্রের অনেক সম্ভাবনার দুয়ার হিসাবে ধারনা করা হচ্ছে, সেখানে ভুমিক্ষয়ের কারণে কৃষিউৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ৮% এবং কৃষিজমির উর্বরতা ও পুষ্টি হ্রাস ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে।
বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল সিস্টেমের বাস্তুতন্ত্রবিদ বব স্কোলস বলছেন -” মাটির উর্বরতা, এর জৈবপদার্থগত বৈশিষ্ট্য এবং ঐ স্থানের সামাজিক বৈশিষ্ট্য উভয়ের সমন্বয়ে গঠিত –যার উপর মনুষ্যজাতি খাদ্য উৎপাদনের জন্য ব্যাপকভাবে নির্ভর করে , কারণ এটি একটি সামাজিক সম্পত্তি “
মাটির উর্বরতা প্রাচীনকালের একটি রহস্য ছিল। পরম্পরাগতভাবে কৃষকদের ধারনা ছিল মাটি হয়তো , ক্লান্ত, অসুস্থ, বা ঠান্ডা হয়ে উঠছে এবং এরকম পরিস্থিতিতে এর সমাধান ছিল কষ্টসাধ্য। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে, মাটি এবং গাছপালা নিয়মিতভাবে পরীক্ষার আওতাধীন আনা হয় এবং এদের ঘাটতিগুলো নির্ণয়ের জন্য এবং এরই সাথেসাথে বিশ্বব্যাপী একটি কৃষি ভিত্তিক রাসায়নিক শিল্প গড়ে উঠে এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য। মাটিকে একটি জড় সহায়ক ম্যাট্রিক্স এর চেয়েও বেশি হিসাবে দেখা হয়,একে আমনভাবে তৈরি করার চেষ্টা করা হয় যেন মাটি পুষ্টিকর এক স্যুপ।
এই সংকীর্ণ পদ্ধতি যদিও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে একটি অভূতপূর্ব নেতৃত্ব প্রদান করেছে , কিন্তু সেই সাথে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি এবং জলাভুমি,নদী , হ্রদ, এবং উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র দূষণের কাজটিকেও ত্বরান্নিত করেছে। বর্তমানে গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্র এক তৃতীয়াংশ কৃষির সঙ্গে যুক্ত ক্রিয়াকলাপের জন্য দায়ী , আর অর্ধেকেরও বেশি অবদান মাটি থেকে উদ্ভূত ।
প্রাকৃতিকভাবে মাটির নিরবচ্ছিন্ন উর্বরতা বজায় রাখার পরিবর্তে আমরা রাসায়নিক সার প্রয়োগ করছি যা মাটির বাস্তুতন্ত্র এবং মানবজাতিকে ঝুকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কেননা এই কৃত্তিম প্রক্রিয়ায় মাটির উর্বরতা প্রতিস্থাপন এর প্রতি নির্ভরশীলতার কারণে এসকল রাসায়নিক দ্রব্যের চড়া মূল্য আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ছে।
যদিও শুধুমাত্র “জৈব” প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা বর্তমান এবং ভবিষ্যতের এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়। আর সম্পূর্ণভাবে “জৈব” প্রযুক্তির উপর নির্ভর হতে হলে আমাদের বিস্তৃত জায়গা নিয়ে কাজ করতে হবে এবং এরকম একটা উদ্যোগ নিয়েও তেমন কোন লাভ হবেনা কেননা এটি জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য এবং নদী শোধনে তেমন কোন সহায়ক ভুমিকা রাখবেনা।
মোটের উপর, একটি টেকসই এবং দিঘস্থায়ী খাদ্য ও কৃষি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন একটি ঘনিষ্ঠ এবং সমন্বিত কৃষি- বাস্তুতন্ত্র যেখানে, মাটিতে গড়ে ওঠা বাস্তুতন্ত্রগুলোকে চাক্রিকভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আর এটি তখনই সম্ভব যখন জৈবপ্রযুক্তি আর অজৈবসার ব্যবহার থেকে আরও বেশী উৎপাদন পাওয়া সম্ভব হবে।
এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক
সুত্রঃ সাইন্সডেইলি