মৃত্তিকাঃ তাঁহার রঙ ইতিবৃত্ত……
মিথিলা চক্রবর্তী
সহজাত প্রশ্ন যদি কেউ করে বসে ; সৃষ্টির আদিমতার কি কোন সাক্ষী আছে ?? নিঃসন্দেহে মৃত্তিকা নড়েচড়ে উঠে উত্তর দেবে, হ্যাঁ আছে বৈকি। আর দেবেই বা না কেন?? সৃষ্টির উন্মাদনার সাথে অপরাপর জড়িত যার জন্ম রহস্য তার পক্ষেই তো কেবল অকৃত্তিম আদিমতার সাক্ষী হওয়া সম্ভব। কিন্তু আদৌ কি কথা বলে মাটি?? কথা বলে না বলেই তো আমরা যখন যে যেভাবে পারি এই বচনঅক্ষম পদার্থ কে ব্যবহার করি যথেষ্ট স্বার্থপরতার সাথে। লাখো বছরের পুরনো পাহাড় কেটে তৈরি করছি জুমের বাগান কিংবা রাস্তা, উঁচুনিচু ভূমিতে আয়োজন করছি নানা রকম খেলা,আবার মাইলের পর মেইল খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে আনছি মাটির ভেতর জমে থাকা মূল্যবান ধাতু, স্বর্ণ, হিরা কিংবা কয়লা। আবার শহরের পর শহর গড়ে উঠছে রাতের আঁধার ফুরোবার আগেই। কিন্তু কখনো কি খেয়াল করে দেখেছি এই মাটিও ভিন্ন দেখায় ভিন্ন অবস্থানে??? মানুষের মধ্যে যেমন কেউ ফর্সা কেউ বা কালো কেউ আবার শ্যামলা ঠিক তেমনি মাটিরও রয়েছে অনেক রঙ। কখনও বা হরিদ্রাভ বাদামী আবার কখনও লাল কখনও যেন একটু ধূসর আবার কখনও বেজায় কালো।গাজীপুর শালবন এলাকার মাটি যেমন রক্ত লাল, তেমনি সিলেট চিটাগাং এলাকায়ও লাল মাটি দেখা জায়,আবার নদী বিধৌত এলাকায় দেখা মেলে ধূসর রঙের মাটির। এখন, প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক কি সে কারণ ??
চলুন দেখি, জানা যায় কিনা এই রহস্যর উত্তর। বলা হয়ে থাকে, মাটির রঙ হচ্ছে তার এমনই এক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যার দ্বারা যেকোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই মাটির বয়স, অবস্থা যেমন; গাঠনিক বৈশিষ্ট্য,বুনট,পানি নিষ্কাশন প্রক্রিয়া, ক্ষুদ্র দলাকার পিণ্ড(mottoles/nodule) সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা পাওয়া যায়। সেজন্য মৃত্তিকা বিজ্ঞানিরা মাটি নিয়ে যেকোনো গবেষণা বা পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে মাটির রঙকে অনেক বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।এবারে দেখা যাক, মাটিতে কি কি রঙ দেখা যেতে পারে; সাধারনত মাটিতে যে সমস্ত রঙ দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে লাল,বাদামী,হলুদ,হলদে-লাল,ধূসর-বাদামী,আবছা-লাল,কালো, ধূসর ইত্যাদি।
এবারে জেনে আসা যাক এই ভিন্নভিন্ন রঙের উৎসগুলো কি ???
তিনটি প্রধান নির্ণায়ক প্রাথমিক ভাবে আলাদা করা যায় যা মাটিতে ভিন্ন ভিন্ন রঙের জন্য দায়ীঃ
(1) মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ,
(2) মাটির পানি ধারণক্ষমতা, এবং
(3) লৌহ এবং ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইডের উপস্থিতি সহ জারনাবস্থা।
বিস্তারিত করলে এটি অনেকটা এরকম দাঁড়ায়ঃ
প্রথমত,লৌহ-অক্সাইড এর বিভিন্ন ঘনত্বের কারণে লাল,হলুদ বা কমলা রঙ দেখা যায় মাটিতে। সেখানে পানির উপস্থিতি রঙগুলোর ঘনত্ব বাড়ায় বা কমায়।
দ্বিতীয়ত,জৈব কার্বনের উপস্থিতি বাদামী বা কালো রঙের জন্য দায়ী।
তৃতীয়ত, কিছু মাঙ্গানিজ-অক্সাইড কালো রঙের ক্ষুদ্র দলার সৃষ্টি করে।
চতুর্থত, পানির উপস্থিতি এবং মাটির ধুয়ে যাওয়া ধূসর রঙের মাটির জন্ম দেয়।
এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন মিনারেল যেমন Calcite, Glauconite রঙের উদ্ভব ঘটায় মাটিতে।
এবার দেখা যাক উপরোক্ত চারটি কারণের কিছুটা বিস্তারিতঃ
প্রথমত,লৌহ-অক্সাইড এর বিভিন্ন ঘনত্বের কারণে লাল,হলুদ বা কমলা রঙ দেখা যায় মাটিতে। সেখানে পানির উপস্থিতি রঙগুলোর ঘনত্ব বাড়ায় বা কমায়।কারণ পানির উপস্থিতি বাতাসের উপস্থিতিকে সরাসরি প্রভাবিত করে বিশেষ করে অক্সিজেন এর উপস্থিতিকে।এই অক্সিজেন লৌহের জারণ অবস্থা স্থির করে যার ফলাফল এই রঙের সৃষ্টি।
দ্বিতীয়ত,জৈব কার্বনের উপস্থিতি বাদামী বা কালো রঙের জন্য দায়ী। প্রচুর পরিমাণ জৈব কার্বন যে মাটিতে থাকে তা কালো রঙ ধারন করে। তবে বাংলাদেশে এই মাটি অনেকটাই কম পাওয়া যায় কেননা বাংলাদেশে জৈব কার্বন এর পরিমাণ খুব কম হয় এবং মাটির তাপমাত্রা, গড় বৃষ্টিপাত ইত্যাদি এর জন্য দায়ী।
তৃতীয়ত, কিছু মাঙ্গানিজ-অক্সাইড কালো রঙের ক্ষুদ্র দলার সৃষ্টি করে ।এইসমস্ত দলার বাইরের রঙ ভিতরের রঙের চেয়ে আলাদা হয়।
চতুর্থত, পানির উপস্থিতি এবং মাটির ধুয়ে যাওয়া ধূসর রঙের মাটির জন্ম দেয়।যেহেতু উপাদানগুলো ধুয়ে চলে যায় সেহেতু মাটিটি হালকা রঙের হয়।
মৃত্তিকা নিয়ে যারা কাজ করে তারা, মানে মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা; আবিস্কারের নেশায় চেপে এই রঙ নির্ণয় করতে ও এবং রঙের বিস্তারিত জানতে শিখে গেছে।মুনসেল কালার চার্ট (Munsell Color Chart) ব্যাবহার করে এই কাজটি করা হয়। এই সিস্টেম এ একটুকরো মাটিকে একটা স্ট্যান্ডার্ড রঙের চিপের সাথে মেলানো হয় একটা রঙের বইয়ে। প্রত্যেকটা চিপ বর্ণনা করা হয় ৩ টি উপাদান দিয়ে, যথাক্রমে ::
(১)হিউ(heu): লাল বা হলুদের ঘনত্ব,
(২)ক্রোমা(chroma): রঙের তীব্রতা এবং উজ্জ্বলতা,যেমন ধূসর রঙের জন্য এটি শূন্য।
(৩)ভ্যালু (value): রঙের লঘু বা ঘন অবস্থা,যেমন কালো রঙের জন্য এটি শূন্য।
রঙের মান নির্ণয়ের একটা উদাহরণ এই পুরো সিস্টেমকেই বুঝতে অনেকটাই সহজ করবে। ধরা যাক Munsell Color Chart এর 10YR 2/1 পাওয়া গেল এবং দেখা গেলো ঐ রঙটি হচ্ছে কালো।যা থেকে সহজেই বুঝা যায় যে মাটিটি লৌহ-অক্সাইড এবং জৈব পদার্থ দিয়ে পরিপূর্ণ। এভাবে সহজেই কোন ধরনের শারীরিক এবং মানসিক কসরত ছাড়াই মাটির রঙ বের করে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলে দেয়া যায়।
রঙের পার্থক্য তীব্র থেকে আরও তীব্র হয় মাটির গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে। মাটির একেকটা লেয়ার (layer) একেকটা রঙ দেখায় একটা পরিলেখার ভেতরেই। এমনকি horizon(horizon: মাটির সাথে সমান্তরাল একটি লেয়ার এটি একটি স্তর যা পানির আসা যাওয়া অথবা ভূ-প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়, যেখানে পরিস্কারভাবে প্রকাশযোগ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় যা মাটির প্রস্তুতিমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত হয়)গুলোও একটা পরিলেখাতে একইরকম hue দেখায় কিন্তু value বা chroma তে বিভিন্ন হয়। কখনও কখনও একিই মাটির টুকরো আলাদা রঙ দেখায়।
এখন জানা যাক যে মাটির কোথায় কোন রঙ দেখা যায়??
সাধারনত A-Horizon গাড় রঙের এবং B-Horizon হালকা হয়। মাটি তৈরিতে যে সিস্টেমগুলো জড়িত তাদের মাঝেরিই দুইটি প্রধান প্রক্রিয়া Eluviation এবং Illuviation এর কারণে একেকটা horizon একেক রঙের হয়। eluviations বলা হয় এমন একটি প্রক্রিয়াকে যেখানে, মাটির উপরের থেকে নিচের লেয়ারে বিভিন্ন উপাদান পানির সাথে মিশ্রিত বা dissolved অবস্থায় স্থানান্তরিত হয়।
শেষ করবো একজন Conservationist এর কথা দিয়ে “For the end we will conserve only what we love. We will love only what we understand. And we will understand only what we are taught.”(BABA DIOUM)
ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি ধৈর্যশীল হও মাটির মত। কেননা কখনই মাটি প্রত্যুতর দেয়না তার ওপর যতই চাপ দেয়া যাক না কেন।তখন উদাহরণ মনে করে না বুঝে মাটি হতে চাইতাম কিন্তু এখন বুঝি বড়দের এই কথা ছিল মাটির প্রতি আমাদের উদাসীনতার বহিঃপ্রকাশ। এতো গুণে গুনান্নিত হবার পরও মাটিকে আমরা নুন্যতম গুরুত্ব দেই না। অথচ খুব ভাল প্রাকৃতিক অবস্থাতেও প্রতি ইঞ্চি মাটি তৈরিতে প্রায় ৭০০ থেকে ২০০০ বছর সময় লাগে। মাটিকে মুখে মা না বলে বরং মন থেকে তার পরিচর্যা হোক আমাদের অঙ্গিকার ।
লেখক, পরিবেশকর্মী।
লেখাটি জনপ্রিয় বিজ্ঞান ম্যাগাজিন ‘জিরো টু ইনফিনিটি’র জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত।