
বেগুনি মৌটুসি ; শত প্রতিকূলতায়ও টিকে আছে যে পাখি
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
মিষ্টি গলার গানে সে মাতিয়ে রাখে প্রকৃতি। ফুলের মাঝে ঠোঁট গুঁজে রসপানের চেষ্টায় ব্যস্ত দিন কাটায়। আমাদের দেশের সব ছোট্টপাখিদের মধ্যে অন্যতম এটি। টুনটুনি থেকেও আকারে ছোট। গহিন জঙ্গল থেকে শুরু করে গাছগাছালিপূর্ণ আমাদের বসতবাড়ির আশে-পাশে প্রায়ই তার দেখা মেলে। প্রকৃতি ও রঙের ভিন্নতার জন্য সব পাখির থেকে একে আলাদা করে চেনে নেয়া যায়। দীর্ঘ ঠোঁটসমৃদ্ধ এ পাখির নাম বেগুনি মৌটুসি। ইংরেজি নাম Purple Sunbird এবং বৈজ্ঞানিক নাম Cinnyri asiaticus। নীলটুনি, দুর্গাটুনটুনি, চিকচিক অঞ্চলভেদে এসব নামেও ডাকা হয় এটিকে।
বেগুনি মৌটুসির আলাদা একটি বৈশিষ্ট্যও আছে। নিজের বাসা তৈরি পর সুযোগসন্ধানী অন্য কোনো পাখি লুকিয়ে এসে সেখানে ডিম পেড়ে চলে গেলেও পাখিটি তাতে তা দিতে কার্পণ্য করে না। বৈশিষ্ট্য বিচারে এ পাখির মাতৃপূর্ণ এক ধরণের আকাঙ্খা রয়েছে। অন্য পাখির ডিমগুলো থেকে ছানা ফোটানোর অতিরিক্ত দায়িত্বটি সযত্নে পালন করে থাকে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সভাপতি এবং স্বনামধন্য পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ পাখিটির একটি বড় গুণ হচ্ছে সে টিকে থাকতে পারছে। আমাদের দেশে যত প্রকারের মৌটুসি পাখি পাওয়া যায় তাদের মধ্যে এই বেগুনি মৌটুসি সর্বাধিক সফল পাখি। অর্থাৎ বিভিন্ন প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে তারা বেশি সংখ্যায় টিকে রয়েছে। গভীর বন থেকে শুরু করে আমাদের বাড়ির আশে-পাশেও তাদের দেখা পাওয়া যায়। ছেলে বেগুনি মৌটুসির অদ্ভুত একটি বৈশিষ্ট হলো ছেলে পাখিটা বাসা তৈরি করে না কিন্তু ডিমে তা দেয়। আবার বাসাটিও পাহাড়া দেয় এবং ছানা জন্ম নিলে ছানাগুলোকেও খাওয়ায়। মেয়ে পাখিটা শুধু একা একা বাসা তৈরি করে। অন্য পাখিদের চেয়ে এটি বেশ আলাদা।’
তিনি আরো বলেন, মৌটুসি পাখির একটি বিশেষ ক্ষমতা হলো এরা হেলিকপ্টারের মত খাড়া হয়ে উড়তে পারে। যা ‘হামিং বার্ড’ ছাড়া আর কোনও পাখির পক্ষে সম্ভব নয়। ডানায় বাতাস ভর করে না বলে অন্যান্য পাখিরা কখনোই খাড়া হয়ে উড়তে পারে না। অনেকেই এই পাখি দেখে এসে আমাকে বহুবার বলেছেন, ‘হামিং বার্ড দখলাম।’ কারণ শুধুমাত্র আমেরিকা মহাদেশ ছাড়া আর কোনো মহাদেশেই ক্ষুদ্র ‘হামিং বার্ড’ পাখিটির দেখা পাওয়া যায় না। হামিং বার্ডের সাথে এর খাড়াভাবে উড়ে বেড়াবার মিল রয়েছে।’
প্রজননের দিকটি উল্লেখ করে ইনাম আল হক বলেন, ‘এরা ঝোপ ও গাছে পাতা, বাকল, ঘাস মাকড়সার জালে আবৃত করে থলের মত ছোট্ট বাসা তৈরি করে। তবে মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাপিয়া অর্থাৎ এশীয় শ্যামা পাপিয়া, বেগুনি পাপিয়া, এশীয় ফিঙে পাপিয়াসহ প্রভৃতি পাখি এদের বাসাতেই লুকিয়ে ডিম পাড়ে। হঠাৎই এসে ওরা বাসাটাকে বাঁকা করে বেগুনি মৌটুসির ডিমগুলো মাটিতে ফেলে দেয়া। তারপর নিজেরা ডিম পেড়ে চলে যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হলো সার্থক শক্তিশালী পাখি অর্থাৎ যারা বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে রয়েছে তাদের বাসাতেই কিন্তু কোকিল, পাপিয়া, ফিঙে এরা ডিম পাড়ে। এতো করে দু’জনেই ছানা জন্ম নেবার সুযোগ সবচেয়ে বেশি থাকে। বেগুনি মৌটুসি একটি সার্থক শক্তিশালী পাখি। কারণ সে ফিঙে ও পাপিয়ার বাচ্চা তোলার পর নিজের বাচ্চা তোলতে পারে। কোকিল কিন্তু কোনো দুর্বল পাখি অর্থাৎ যারা সংখ্যায় পর্যাপ্ত নয় এমন পাখির বাসায় ডিম পাড়ে না। কোকিল সর্বদাই কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। কারণ কাক একটি সবল পাখি। যে কোকিলের বাচ্চা তোলার পরও পুনরায় বাসা তৈরি করে নিজের ডিম পাড়ে বাচ্চা ফুটাতে পারে। সেজন্যই কাকও টিকে আছে আবার কোকিলও টিকে আছে। কোকিল যদি দুর্বল পাখির বাসায় ডিম পারত তাহলে কোকিলও ধ্বংস হয়ে যেতো এবং ওই দুর্বল পাখিটিও ধ্বংস হয়ে যেতো।’
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সূত্র জানায়, বেগুনি মৌটুসি বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি। বাংলাদেশে প্রায় নয় রকমের মৌটুসি পাখি দেখা পাওয়া যায়। বেগুনি মৌটুসির দৈর্ঘ্য ১০ সেমি এবং ওজন ৭.৭ গ্রাম। ছেলে পাখিটির কাঁধ নীল, ডানা কালচে, লেজ ও পিঠ ফিকে জলপাই-বাদামি এবং দেহতল হলুদ। তবে প্রজননকালে ছেলেপাখির পিঠ ধাতব নীল-সবুজ আর বেগুনি, বুক ও গলা ধাতব বেগুনি এবং ডানা ও লেজ কালচে রং ধারণ করে। মেয়ে পাখিটি পিঠ জলপাই-বাদামি এবং দেহতল হালকা হলুদ। তার খাদ্য তালিকায় রয়েছে প্রধানত ফুলের রস। তবে ছানাকে খাওয়ার জন্য সে ক্ষুদ্র পোকাও সংগ্রহ করে খায়। এরা দুই থেকে তিনটি ডিম পাড়ে। ডিমের রং ধূসরাভ-সাদা। মেয়েপাখিটি একা ১৪-১৫ দিন ডিমে তা দিয়ে ছানা ফুটায়। মধ্যপ্রাচ্য হয়ে দক্ষিণ, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ায় এ পাখির বৈশ্বিক বি¯তৃতি রয়েছে।
লেখক : প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক এবং
দৈনিক কালের কণ্ঠের শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
biswajit.bapan@gmail.com
সূত্র : ১৯ আগস্ট ২০১৩ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠ