বৃষ্টি বনের এক কিস্তি……
ফারজানা হালিম নির্জন
চারপাশে সবুজের আঁকিবুঁকি আর মাথার উপর তাকালেই,পাতার ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশ। রোদের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে যেন অনেক অনেক বছর কেটে গেছে। এখন আর সেই বয়স নেই,শুনশান নীরবতা সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। হঠাৎ হঠাৎ প্রাণিকূলের অদ্ভুত সব শব্দ শরীরে কাঁপন তুলে দেয়! নাম না জানা পাখিদের কিচিরমিচির ধ্বণি,গা ছমছমে রহস্যঘেরা পথ,হঠাৎ হঠাৎ অবাক করে দেয়া ঝোপঝারে ঢাকা মস্ত বড় খাঁদ,সবকিছু একসাথে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বিজ্ঞ অভিভাবক। উল্টোপাল্টা কিছু করলেই যেন কড়া ধমক দিয়ে থামিয়ে দিবে। এ যে শুধু ফরেস্ট নয়,রেইন ফরেস্ট বলে কথা !
রেইন ফরেস্ট অর্থাৎ বৃষ্টিবন! এখানে নাকি সারা বছর বৃষ্টি হয়! প্রথমবার শোনার পর নিশ্চয়ই গা শিরিশিরে এক আনন্দ,ধমনীতে দ্রুত বেগে ঢেউ তুলে যায়। তারপর মনে মনেই নানা ধরণের প্রশ্ন খেলতে থাকে। শুধু কি এই ফরেস্টেই সারা বছর বৃষ্টি হয়,কিন্তু কেমন করে! পৃথিবীর একপ্রান্তে যখন ভয়াবহ খরা চলছে,তখনও! তবে কি কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে দাদুভাই পৃথিবীতে শিকড় গেড়ে বসে আছেন! হয়তো অনেকেই জানি এই রহস্যময়ী রেইন ফরেস্ট সম্পর্কে,তবু জানিনা অনেক কিছুই। তাহলে জেনে ফেলি,রহস্যময়ী দাদুর পেটের খবর।
‘রেইন’ এই শব্দ দিয়েই রেইন ফরেস্ট কে অন্য যেকোনো সাধারণ ফরেস্ট থেকে আলাদা করে ফেলা যায়। এখানে সারাবছর বৃষ্টি হয় এবং বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হলো ২৫০ থেকে ৪৫০ সেন্টিমিটারের মধ্যে। কিন্তু বৃষ্টি কেন হয় ? এই পুরো ফরেস্ট টিকে আগলে রাখে বড় বড় ছায়াবৃক্ষ। রেইন ফরেস্টের সব ধরণের গাছ নিজেদের দেহ থেকে পানি নিঃসরণ করে,মানবজাতি যেমন নিঃসরণ করে ঘাম। গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইনফরেস্টের মাত্র একটি ছায়াবৃক্ষ বছরে প্রায় ২০০ গ্যালন (৭৬০ লিটার) পানি নিঃসরণ করতে পারে ! এভাবে সমস্ত বনের গাছদের নিঃসরিত পানি জড়ো হয়ে তৈরী হয় এক আর্দ্র পরিবেশ। আর্দ্রতা একটা ভারী মেঘের রূপ নিয়ে সম্পূর্ণ বনটিকে ঢেকে রাখে নিবিড় মমতায়। তো বৃষ্টি কেন হবেনা ? তাছাড়াও,যখন বৃষ্টি হয়না,তখনও এই ছায়ামেঘ সমস্ত ফরেস্টটিকে তার স্বভাবজাত পরিবেশ তৈরী করে দেয়,যাতে তার নামের সার্থকতা অক্ষুন্ন থাকে।
পৃথিবীতে রেইন ফরেস্ট কে দুটি ভাগে ফেলা হয়েছে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় আর শীতপ্রধান,এই দুটোর মধ্যে বেশি আলোচিত এবং তথাপি পরিমাণেও অনেক অনেক বেশি হলো গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইনফরেস্ট। উত্তর আমেরিকা,ইউরোপ এবং পূর্ব এশিয়া তে কিছু কিছু শীতপ্রধান অঞ্চলের রেইন ফরেস্ট রয়েছে।তবে তার পরিমাণ অপরটির তুলনায় নিতান্তই কম। আর ট্রপিকাল কিংবা গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইন ফরেস্ট গুলো রয়েছে পুরো পৃথিবী ছড়িয়ে। দক্ষিণ এশিয়া,দক্ষিণ আমেরিকা,মধ্য আমেরিকা,আফ্রিকা সহ আরো বিভিন্ন অঞ্চলে এদের পরিব্যাপ্তি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় রেইনফরেস্ট অ্যামাজান রেইন ফরেস্টটিও কিন্তু এর অন্তর্ভুক্ত ! যেখানে আছে প্রায় ১৬০০০ প্রজাতির ৩৯০ বিলিয়ন গাছ! বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর মোট রেইনফরেস্টের প্রায় অর্ধেকটা সে একাই ধারণ করছে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইন ফরেস্ট কে বলা হয় ‘জুয়েল অব দ্যা আর্থ’ !
আরেকটি মস্ত বড় উপাধিও কিন্তু রেইন ফরেস্ট কেড়ে নিয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড’স লারজেস্ট ফার্মাসী’ অর্থাৎ পৃথিবীর সবচাইতে বড় ঔষধালয়! কেন বলবে না! প্রাকৃতিক ঔষধের এক চতুর্থাংশ যে এখান থেকেই আসছে। ধারণা করা হয়,রেইন ফরেস্টের মিলিয়ন মিলিয়ন প্রজাতির গাছ,পোকা-মাকড়,অণুজীব এখন পর্যন্ত অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে। ‘দ্যা ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট’(এন.সি.আই) এর গবেষণার প্রেক্ষিতে বলা হচ্ছে,পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ অ্যাণ্টি-ক্যান্সার সনাক্তকারী গাছ এই রেইন ফরেস্টে !এমনকি এইচ.আই.ভি ভাইরাসকে পুরোপুরি নির্মূল করতে বিজ্ঞানীরা যে প্রতিষেধক তৈরীর কাজ করছেন,তারও মূল উপাদান ক্যালেনলিড-এ, ‘বর্নিও রেইনফরেস্ট’ এর একটি গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ।
বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের পরম সৌভাগ্য,সিলেটের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার দুই সীমান্তের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ১২৫০ হেক্টর বনভূমি জুড়ে ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের একমাত্র রেইনফরেস্ট ‘লাওয়াছড়া’এখানে প্রায় ৪৬০ প্রজাতির জীবের বসবাস।
রেইনফরেস্ট,পৃথিবীর প্রায় ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ প্রাণিকূলের আদি নিবাস!এছাড়াও পৃথিবীর মোট ২৮ শতাংশ অক্সিজেনও নাকি আমরা রেইন ফরেস্ট থেকেই পাচ্ছি! দাদুভাই গম্ভীর ভঙ্গিতে তো কেবল দিয়েই যাচ্ছেন আমাদের। কিন্তু আমরা তাঁকে কতটুকু সেবা দিতে পারলাম অথবা পারছি ! পৃথিবীর মোট ৩০ শতাংশ রেইনফরেস্ট ব্রাজিলে। ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে শুধুমাত্র গাছ কেটে উজাড় করে ফেলার কারণে ব্রাজিলের রেইনফরেস্টের প্রায় ৫০,০০০ বর্গ মাইল অংশ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। জীববিজ্ঞানীদের আশংকা,এর ফলাফল হলো দীর্ঘমেয়াদী ভয়াবহ খরার মুখোমুখি হওয়া। বিশ্বের সবচাইতে বড় রেইনফরেস্ট,অ্যামাজান রেইনফরেস্ট ১৯৯০ সালে এই ভয়াবহ খরার মুখোমুখি হয়েছে। কারণটি ছিলো অতিরিক্ত গাছ কেটে বন উজাড় করা আর বৈশ্বিক উষ্ণতা। বন উজাড় করার বিপরীতে নানাধরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিন্তু তার ভিত্তিটা যে বড়ই নড়বড়ে ! তাই পরিবর্তনটাও খুব বড় আকারে চোখে পড়ার মত নয়।
ছেলেমানুষীর মত একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছি আমরা। নিজেদের কর্মফলের কারণেই যে অদূর ভবিষ্যতে ভাগ্য আমাদের পরিহাস করার সুযোগ ছাড়বে না,তা যেন আমরা বুঝেও বুঝতে চাইছিনা। দাদুভাই যেন আমাদের সেই ছেলেমানুষিটাকে ক্ষমা করেই এখনো অভিভাবকের মতো ঘিরে রেখেছে তাঁর ছত্রছায়ায়। নিজে কষ্ট পাচ্ছে,ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে,তবুও অভিমান বুকে জড়ো করে আমাদেরকে আগলে রাখছে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু এভাবে আর কতদিন দিয়ে যাবেন তিনি? এবার কি তাঁর দেখাশোনা করার দায়িত্বটা আমাদের নেয়া উচিত নয় ?