বৃষ্টিবিলাসী এক পাখির গল্প
বাংলাদেশ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট ট্রেনিং একাডেমি (CEVTA) এর গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে এখানকার সবুজ প্রকৃতি যে কারোরই মন কেড়ে নেবে। একাডেমির ভেতরে দেশি-বিদেশি গাছপালার সমারোহে যদিও বিদেশি বৃক্ষদেরই জয়জয়কার। মেহগণি, একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস প্রভৃতি বিদেশি গাছপালার ভিড়ে কোনরকমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে অল্প কিছু আম, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদি দেশি বৃক্ষ। বিদেশি গাছও বাতাসে অক্সিজেন ছাড়ছে ঠিকই কিন্তু এ গাছগুলো আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করছে। আর এ কারণেই এত গাছপালার প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও এখানে পাখির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। তারপরও একাডেমিতে পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বর্ণিল পাখাদার এই বন্ধুদের সংখ্যা একেবারে কমও নয়। একাডেমিতে আমার গত পাঁচ মাসের অবস্থানকালে কমপক্ষে ৩০ প্রজাতির পাখি চোখে পড়েছে। সারা বছরজুড়ে এই সংখ্যা ৫০ এর কম হবে না। এরমধ্যে প্রায় সব প্রজাতিই আমাদের স্থায়ী বাসিন্দা (একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল দুটি পরিযায়ী বন খঞ্জন বা Forest Wagtail)। এখানে আমাদের অতি পরিচিত পাখি কাক (House Crow), চড়ুই (House Sparrow), বুলবুলি (Red-vented Bulbul), তিলা ঘুঘু (Spotted Dove) ইত্যাদি যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে চঞ্চল নীলটুনি/বেগুনি মৌটুসি (Purple Sunbird), নয়নাভিরাম হলদে-পা হরিয়াল/বটকল (Yellow-footed Green Pigeon), বাহারি নীললেজ সুঁইচোরা (Blue-tailed Bee-eater), সুদর্শন লক্ষ্মীপ্যাঁচা (Barn Owl) এর মতো তুলনামূলক কম চোখে পড়ে এমন পাখিরাও। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে এই একাডেমির সবচেয়ে আকর্ষণীয় পাখি কিন্তু এদের কোনটিই নয়। আর এই খেতাব যিনি জয় করেছেন তিনিই আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু—একটি মাছরাঙ্গা।
একাডেমিতে মোট ৩ প্রজাতির মাছরাঙ্গার নিয়মিত দেখা মেলে। প্রথম দুটি প্রজাতি পাতি মাছরাঙ্গা (Common Kingfisher) ও সাদাগলা মাছরাঙ্গা (White-throated Kingfisher) সারা দেশে বেশ সহজলভ্য। তবে আমাদের আলোচ্য পাখিটির সংখ্যা সে তুলনায় অপ্রতুল। একাডেমির পুকুরের আশেপাশের গাছের ডালে পাখিটিকে প্রায়ই বসে থাকতে দেখা যায়। আর দেখা না গেলেও তার ডাক শোনা যায় নিয়মিতই। এখানে কমপক্ষে এক জোড়া পাখি রয়েছে। আমি তিনটা পাখিকে কাছাকাছি দেখেছি এবং ডাক শুনে মনে হয়েছে সংখ্যাটা আরো বেশি হতে পারে। অনিন্দ্যসুন্দর এই পাখিটি যে একটি মাছরাঙ্গা তা দেখলেই যে কেউ চিনবেন। একই সাথে অবাকও হয়ে যাবেন এর আকৃতি দেখে কারণ এত বড় মাছরাঙ্গা সচরাচর দেখা যায় না। মাঝে মাঝে এই পাখিটিই গম্ভীরস্বরে ‘মেঘ-হও, মেঘ-হও’ বলে ডাকে যেন তার বৃষ্টি খুব দরকার। কাঙ্খিত সেই বৃষ্টি নামলে সে মহানন্দে বৃষ্টিতে ভিজে। এরকম বৃষ্টিবিলাসী পাখি আর আছে কি? শ্রাবণের আকাশের অঝোর ধারার বৃষ্টি কি তবে পাখিটির প্রার্থনা পূরণের জন্যেই? আর বোধহয় এ কারণেই তার নাম হয়েছে মেঘহও মাছরাঙ্গা। গুরিয়াল বা শুধু মেঘহও নামেও পরিচিত। তাই বলে আপনি যদি বৃষ্টি পছন্দ না করেন তাহলে ওকে দুষতে যাবেন না যেন। অবশ্য আপনার পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে মেঘহও এর কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। বৃষ্টি হলেই সে খুশি। Halcyonidae পরিবারের সদস্য এ মাছরাঙ্গার ইংরেজি নাম Stork-billed Kingfisher, বৈজ্ঞানিক নাম Pelargopsis capensis। এই পাখিকে ইংরেজিতে Mystery Bird বা Misleading Bird-ও বলা হয়ে থাকে। অবশ্য কেন এমন নামকরণ তা জানা যায়নি। মেঘহও বেশ বড় আকৃতির পাখি, বাংলাদেশের মাছরাঙ্গাদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রজাতি। এটি লম্বায় ৩৫-৩৮ সেমি (১৪-১৫ ইঞ্চি), ডানা ১৫.৭ সেমি, ঠোঁট ৯ সেমি ও লেজ ১০ সেমি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথার চাঁদি উজ্জ্বল বাদামি, গলবন্ধ কমলা-পীতাভ, কাঁধ-ঢাকনি বাদামি-নীল। ডানার রঙ চমৎকার নীলচে সবুজ। পিঠ ও কোমরের পালকের রঙ নীল। বুক, পেট ও অবসারণী কমলা-পীতাভ রঙের। ডানার প্রান্ত-পালকের রঙ গাঢ় নীল যার অগ্রভাগ কালচে রঙের, লেজের পালক হালকা নীল রঙের। বিশাল ছোরার আকৃতির ঠোঁটের রঙ টকটকে লাল যার প্রান্তভাগ কালো। কালো চোখের চারদিকে লালচে বলয়। লাল পায়ের নখ কালো। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকমের। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির বুকে কালো ডোরা দেখা যায়। পৃথিবীজুড়ে পাখিটির ১৫টি উপ-প্রজাতি রয়েছে, বাংলাদেশে P. c. capensis উপ-প্রজাতিটি দেখা যায়।
মেঘহও মাছরাঙ্গা বনের জলধারা, ধীরে বয়ে চলা নদী, নদীর পাশের আবদ্ধ জল, বিল, বাঁওড়, সেচের নালা, জোয়ারের পানিভর্তি খাঁড়ি ও পুকুরে বিচরণ করে। পাখিটি নিঃসঙ্গ স্বভাবের, সাধারণত একা বা জোড়ায় বিচরণ করে। জোড়ায় থাকলেও সাধারণত দুটিকে পাশাপাশি কমই দেখা যায়। তবে দেখা না গেলেও জোড়ার পাখিটি কাছাকাছিই থাকে। পানির আশেপাশে গাছের উঁচু কোন ডালে বা খুঁটিতে নিঃশব্দে বসে শিকারের অপেক্ষা করে। অসতর্ক কোন শিকার পেলেই দ্রুততার সাথে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারকে পাকড়াও করে আবার কোন ডালে গিয়ে বসে। তারপর শিকারকে ডালের সাথে বারবার আছড়ে মেরে শিকারের ভবলীলা সাঙ্গ করে অতঃপর তা গলাধঃকরণ করে। প্রধান খাবার মাছ হলেও খাদ্যতালিকায় আরও রয়েছে ব্যাঙ, কাঁকড়া, ছোট সরীসৃপ, পাখির ছানা, পাখির ডিম, ইঁদুর ইত্যাদি। পাখিটির কয়েক রকমের ডাক লক্ষ্য করা যায়। ডাল ছেড়ে উড়ে যাওয়ার সময় সাধারণত উচ্চস্বরে ‘ক্যা-ক্যা-ক্যা-ক্যা-ক্যা’ করে ডাকে। প্রজনন মৌসুমের ডাক হচ্ছে সুরেলা কণ্ঠের একটানা ‘পিউ-পিউ…পিউ-পিউ…পিউ-পিউ।’ আর মাঝে মাঝেই শোনা যায় গম্ভীর স্বরের ‘মেঘ-হও…মেঘ-হও’ ডাক। মেঘহও এর প্রজননকাল জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর। অন্যান্য সব মাছরাঙ্গার মতোই জলাশয়ের খাড়া পাড়ে গর্ত খুঁড়ে সুড়ঙ্গের ভেতর বাসা বানায়। তবে গাছের গর্তে বাসা বানাতেও দেখা যায়। বাসা বানানো শেষে সাদা রঙের ৪-৫টি ডিম পাড়ে। ডিমের মাপ ৩.৬ × ৩.১ সেমি। মেঘহও আমাদের একটি স্থায়ী প্রজাতির মাছরাঙ্গা যা তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়। বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা এবং রাজশাহী বিভাগের পুকুর ও জলাশয়গুলোতে পাখিটি চোখে পড়ে। এ পাখির বিস্তৃতি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো জুড়ে যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ব্রুনেই, লাওস, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। পাখিটির স্বভাব স্থানিক প্রকৃতির, নিজের সীমানার মধ্যে এলে ঈগল বা অন্যান্য বড় শিকারি পাখিদেরও তাড়িয়ে দেয়।
The IUCN Red List of Threatened Species অনুযায়ী পাখিটি ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত (Least Concern) হলেও বাংলাদেশে অন্যান্য অনেক প্রজাতির পাখির ন্যায় এই পাখিটিও হুমকির সম্মুখীন। বিভিন্ন কারণে এদের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক কমেছে যার মধ্যে মানবসৃষ্ট কারণগুলোই মুখ্য তা বলা বাহুল্য।তবে আশার কথা আমাদের কাস্টমস ট্রেনিং একাডেমির মেঘহও পরিবার বেশ নির্বিঘ্নেই তাদের ঘর-সংসার টিকিয়ে রেখেছে এবং বংশবৃদ্ধিও করছে। একাডেমির পাখিগুলো বেশ নির্ভীক। আশেপাশে মানুষের উপস্থিতি সম্পর্কে এদেরকে বেশ নির্বিকার মনে হয়েছে। সৌভাগ্যের ব্যাপার যে এখানে এদের শিকার করার জন্যে গুলতি বা এয়ারগান হাতে কোন শিকারি নেই বরং একাডেমির পুকুরগুলোতে এদের জন্যেই পর্যাপ্ত শিকার রয়েছে। বৃক্ষচয়নে আরও সচেতনতার পরিচয় দিলে অর্থাৎ বেশি করে দেশি গাছপালা লাগালে আর বহিরাগতদের উৎপাত বন্ধ করা গেলে এই একাডেমি পাখিদের জন্যে একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হতে পারে। আশা করি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারটি গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখবেন। আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাখিদের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই পাখিকে শুধু উপাদেয় খাদ্য হিসেবে বিবেচনা না করে এদের সংরক্ষণে মনোযোগী হওয়াটা এখন সময়ের দাবি। এরই মধ্যে আমাদের বেশ কিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে, আরো অনেক প্রজাতির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। শুধু পাখি নয় আমাদের সকল বন্যপ্রাণির ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। বন্যপ্রাণিদের এই দুর্দশার জন্যে আমরা মানুষেরাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী। তাই ওদের সংরক্ষণের উদ্যোগও নিতে হবে আমাদেরই। এর মধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই আসুন আর দেরি না করে আমরা আমাদের পাখিসহ সকল বন্যপ্রাণিদের সংরক্ষণে এগিয়ে আসি। পাখি বা বন্যপ্রাণিপ্রীতি কিন্তু হেসে উড়িয়ে দেওয়ার কোন বিষয় নয়। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুন্দর বসবাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দেওয়ার কথা বলি। কিন্তু মুখে তা বললেও পৃথিবীর অপরিহার্য উপাদানগুলোকে সংরক্ষণের ব্যাপারে আমাদের ঔদাসীন্য ঠিক তার বিপরীত বার্তাই দিচ্ছে। পরিবেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি আমরা করে চলেছি সে জন্যে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই পৃথিবীতে আমাদের বন্যপ্রাণিদেরও বেঁচে থাকার ঠিক ততটাই অধিকার যতটা অধিকার আমাদের মানুষদের।
লেখকঃ আলী রেজা হায়দার
সহকারী কমিশনার, আবগারি শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগ