বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস '১৩ : মৃত্তিকা কথন
সাইফুর রহমান সুমন
” মাটির গভীর থেকে উঠে আসা ভালোবাসা…
হৃদয়ে হৃদয় মিলে গড়ব সবাই।।”
বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে দেশের বিশিষ্ট কণ্ঠ শিল্পীদের সম্মিলিত গানে উঠে এসেছিল উপরোক্ত চরণ দুটি। সত্যিই তো তাই, প্রকৃতির প্রকৃত ভালোবাসা মাটির গভীর থেকে উঠে আসে। কঠিন মাটির বুক চিঁড়ে যে ফসল উঠে আসে তাই মানুষ ও সমগ্র জীবকূলের জীবন ধারণের প্রধান খাদ্য হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। আজ ৫ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সাল। বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। আন্তর্জাতিকভাবে ২০০২ সাল থেকে দিবসটি সমগ্র বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।
আন্তর্জাতিক খাদ্য বিষয়ক সংস্থা ‘ফুড এন্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন’ (FAO) থাইল্যান্ড সরকারের অবকাঠামোগত উদ্যোগে ২০০২ সালের ৫ই ডিসেম্বরকে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে পালন করার আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রাক্তন থাই রাজা ভূমিবল আদোল ইয়াদেজ পৃথকভাবে মৃত্তিকা দিবস পালন করার ব্যাপারটিকে ত্বরান্বিত করেন। তাঁর সম্মানার্থে ২০০২ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি সমগ্র বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। থাই রাজা ভূমিবল একই সাথে মৃত্তিকা বিজ্ঞান ও মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়নের পেছনেরও নেপথ্য নায়ক। এবছর ইতালির রোমে গ্লোবাল সয়েল পার্টনারশিপের আয়োজনে দিবসটিকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিকভাবে একটি ইভেন্ট পরিচালিত হবে। মৃত্তিকা সম্পদের গুরুত্ব সমগ্র বিশ্বব্যাপী তুলে ধরার প্রয়াসে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে এর যথাযথ ব্যাবহার নিশ্চিতকল্পে দিবসটি পালন করা হয়। ‘ফুড এন্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন’ (FAO) এবং গ্লোবাল সয়েল পার্টনারশিপের উদ্যোগে ২০১৫ সালকে বিশ্ব মৃত্তিকা বছর ঘোষণা করা হয়েছে।
আমাদের পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল। স্থলভাগের মৃত্তিকার বর্তমান অবস্থা একদম পৃথিবীর জন্মলগ্নের সময় এরুপ ছিল না। কঠিন শিলা পাথরের ক্রমান্বয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ক্ষয় সাধনের ফলাফল আমাদের আজকের এই মৃত্তিকা। এই বিশেষ ক্ষয় কিন্তু আবার শ্রেণীবিভক্ত। এটি তিন ভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে। এক. পদার্থের ভৌত অবস্থার পরিবর্তন,
দুই. পদার্থের রাসায়নিক ক্ষয়,
তিন. জৈবিক পদার্থের ক্ষয়।
বিভিন্ন রাসায়নিক ও জৈবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মাটি গঠিত হয়ে থাকে। মৃত্তিকার গঠন উপাদানকে শতকরা হিসেবে চার ভাগে বিভক্ত করা যায়। এক. ২৫ শতাংশ পানি ও দুই. ২৫ শতাংশ গ্যাসীয় পদার্থ, এই অর্ধ শতাংশ মাটির ক্ষুদ্র ফাঁপা স্থান জুড়ে থাকে, মাটির ভিন্নতা ও জলবায়ুর অবস্থা অনুযায়ী এর কম বেশি হয়ে থাকে। বাকি অর্ধ শতাংশের এক ভাগ খনিজ উপাদান (৪৫ শতাংশ) এবং আরেক ভাগ জৈবিক পদার্থ দ্বারা গঠিত (৫ শতাংশ)। খনিজ উপাদান সমুহের মধ্যে বিশেষভাবে রয়েছে সিলিকন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, কার্বন, কেলসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ম্যাংগানিজ, পটাশিয়াম প্রভৃতি। প্রাথিমিক অবস্থা থেকে শেষ অবস্থা অর্থাৎ ভূত্বকের নরম আবরণ এই মাটি তৈরি হতে হাজার বছরেরও বেশী সময় নেয়।
মাটির উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। উদ্ভিদ যে পুষ্টি গুণে বেড়ে উঠে তা সে আহরণ করে মাটি হতে। খাদ্য হিসেবে সেই উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল সমগ্র মানব জাতি ও প্রাণীজগৎ। মাটি তার স্বীয় বক্ষে ধারণ করে উদ্ভিদ ও অনুজীব এর খাদ্য হিসেবে বিভিন্ন পুস্টি উপাদান। মাটির অভ্যন্তরস্থ পানির সাথে এই পুষ্টি উপাদান সমুহের এক মিথস্ক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় নতুন এক রসায়ন। পরবর্তীতে তা উদ্ভিদ ও অনুজীবের আহরণ যোগ্য পুষ্টি উপাদানে পরিণত হয়। উদ্ভিদ তার মূল দ্বারা এই পুষ্টি উপাদান গ্রহন করে থাকে। সামগ্রিকভাবে এই প্রক্রিয়াটি মাটির উর্বরতা ক্ষমতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মাটির উর্বরতা ক্ষমতা কমার সাথে সাথে পুষ্টি উপাদান মান ও পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে।
মাটি একটি অনবায়নযোগ্য ও সসীম প্রাকৃতিক সম্পদ। একে বারবার নবায়নযোগ্য করা যায় না। তাই এর ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা হওয়া উচিত যথাযথ। প্রাকৃতিক এই সম্পদ বিশ্বব্যাপী প্রতিনিয়ত ক্ষয় হয়ে চলেছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট কারণে ক্ষয়ে চলেছে আমাদের এই ভূমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ।
মাটি, পানি ও পরিবেশ একে অপরের সহিত নিবিড়ভাবে জড়িত, যেন একই সুতায় গাথা মালা। বিভিন্ন কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় উপাদান মাটি ও তৎসংলগ্ন পরিবেশের সাথে আদান প্রদান করে, এমনকি শক্তিও (যেমন তাপ)। মাটির পুষ্টি উপাদান দিক বিবেচনা করাই মাটি নিয়ে গবেষণা করার একটি বিশেষ মাধ্যম। বিভিন্ন কারণে আজকে ধংসের মুখে মৃত্তিকা সম্পদ। গত কয়েক দশকে মাটি ক্ষয়ের পরিমাণ দ্বিগুণ থেকে তিনগুন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা ও এর উর্বরতা বৃদ্ধিই মৃত্তিকা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার সাথে পানি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনাও জড়িত।
জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কোন নতুনভাবে আলোচিত বিষয় নয়। এই জলবায়ু পরিবর্তনেও রিয়েছে মৃত্তিকার ভুমিকা। কিভাবে? গঠন উপাদানে আমরা আগেই দেখেছি যে মাটি কার্বনের একটি উৎস, সেটি হতে পারে গ্যাসীয় পদার্থ (CO2) রুপে অথবা মিনারেল উপাদান হিসেবে। সমুদ্রের পরে মাটিই কার্বনের বিশাল জলাধার। এই কার্বন বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ভুমিকা রেখে চলেছে। একই সাথে ক্ষতি করে চলেছে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের। সামগ্রিকভাবে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের এক অগ্রগণ্য নিয়ামক।
মৃত্তিকার দূষণ
মৃত্তিকা দূষণ আমাদের পরিবেশবাদীদের জন্য একটি বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন কারণে দূষিত হচ্ছে আমাদের এই বৃহৎ প্রাকৃতিক সম্পদ। গৃহস্থালি বর্জ্য, কল কারখানার কঠিন ও তরল বর্জ্য মাটি দূষণের একটি বড় উৎস। ল্যান্ডফিলসমুহ (ময়লার ভাগাড়) আরেকটি মারাত্তক মাটি দূষণকারী। এটি ল্যান্ডফিলস্থিত জায়গার মাটি ও আশেপাশের মাটির গুনাগুণ পরিবর্তন সাধনে বৃহত্তর ভুমিকা রেখে চলেছে। যদিও এটি মাটিকে কিছু প্রয়োজনীয় উপাদান প্রদান এবং জৈব পদার্থের এক উৎস হিসেবে কাজ করে, তারপরও এতে অধিকাংশই অপরিশোধনযোগ্য ও অপচনযোগ্য এবং এর থেকে উদ্ভূত ক্ষতিকর প্রভাবটাই বেশী। মাটি দূষণ হওয়ার ফলে কৃষকরা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ এতে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী দেখা দিচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা জনিত সংকট।
দূষিত মাটি একই সাথে ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানির উৎস এবং ভূ-উপরিস্থ জলাধারসহ সব ধরনের পানির উৎসকে করছে দূষিত। তৈরি করছে আর্সেনিক দূষণের মত বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান (heavy metals) গঠিত দূষণ। পাশাপাশি বৃষ্টির পানির সাথে দূষিত মাটি ধুয়ে গিয়ে পড়ছে পার্শ্বস্থ খাল – বিল, নদী, পুকুর, হ্রদসহ সবধরনের পানির উৎসে, তৈরি করছে পানি দূষণের আরেক নির্মম অধ্যায়।
পরিশেষে
মৃত্তিকা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খাদ্য ও বাসস্থানের প্রধান ও অন্যতম মাধ্যম এই মৃত্তিকা। তাই এর নিরাপত্তার জন্য চাই সঠিক ব্যবস্থাপনা। মৃত্তিকার উন্নয়ন মানেই ফসলের গুনগত মানের উন্নতি এবং তা নিশ্চিত করে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা। একাই সাথে জলবায়ু পরিবর্তন রোধের জন্য মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনাও একান্তভাবে জরুরি।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও যথাযথভাবে মৃত্তিকা সম্পদের ব্যাবহার ও ব্যবস্থাপনা করা হয়ে আসছে না। সরকারি ও বেসরকারি সকল উদ্যোগের পাশাপাশি আমাদের সকলেরই উচিত এব্যাপারে আগিয়ে আসা। environmentmove.earth এর পক্ষ থেকে আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এর নিরাপত্তা ও এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা কামনা করছি। মাটি, মাটির উর্বরতা ও খাদ্য নিরাপত্তা হোক পরিবেশবাদীদের চিন্তার ও বিজ্ঞানীদের গবেশনার বিষয়, মৃত্তিকা দিবসে এই হোক আমাদের সকলের মূলমন্ত্র।
এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক