‘বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন-২০১৩' : বহু নাটকীয়তার পর একটুখানি আশার আলো
ফারজানা হালিম নির্জন
রাজ দরবারে সভা চলছে। মূল উদ্দেশ্যএকটাই,রাজ্যের ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য আবাসস্থল গড়ে তোলা। উপস্থিত আছেন সব মন্ত্রী।একে একে উপস্থাপন করছেন তাদের আর্জি। কিন্তু একী বিপত্তি? রাজ্য সংরক্ষণের নীতিমালা নির্ধারণে একমত হওয়াতো দূরেরকথা,সভায় তৈরী হলো দুটি দলের মত-পার্থক্য এবং একে অপরকে দোষারোপ। একদলে ‘প্রভাবশালী’ মন্ত্রীরা এবং আরেকটি দলে চলে গেলো প্রায় ক্ষমতাহীণ একটু ‘কমপ্রভাবশালী’ মন্ত্রীরা। বর্তমান ক্ষমতার প্রভাবে,প্রভাবশালীরা যেন তাদের স্বার্থপরতা টিকেই অটুট করে রাখলো। আর অন্যদিকে,প্রায় ক্ষমতাহীণ কম প্রভাবশালী মন্ত্রীরা প্রভাবশালী দের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে তাদের ক্ষতিকর কর্মকান্ড গুলো,যারজন্যই রাজ্য আজ ধ্বংসের মুখে।রাত গড়িয়ে সকাল হলো,আবার বসলো সভা। চলছে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অতঃপর,প্রজাদের সান্ত্বনা দিতে,সভার বর্ধিত শেষদিনে এসেই তাড়াহুড়ো করে কিছু বিষয়ে তাঁরা একমত হলেন;যেগুলোর লিখিত চুক্তি হিসেবে রূপ নিতে সময় লাগবে আরো ২বছর এবং বাস্তবায়িতরূপ দেখতে প্রজাদের অপেক্ষা করতে হবে গুণেগুণে আরো ৫টিবছর!
বলছিলাম, ‘বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন’ এরকথা। পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে গত ১১ইনভেম্বর থেকে শুরু হয়েছিলো ‘কনফারেন্সঅবপার্টিজ’(COP19) শীর্ষক ‘বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন’২০১৩। এবারের কনফারেন্সের মূল উদ্দেশ্য ছিল,গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে২০১৫সালে প্যারিসে যে চুক্তি গ্রহণ করা হবে,তার একটি খসড়া প্রণয়ন করা। টানা ১৩ দিনের বৈঠকে,নানামত-পার্থক্য এবং হতাশার পর,বর্ধিত শেষ দিনে কিছু বিষয়ে একমত হলেন অংশ নেয়া ১৯৫টি দেশের প্রতিনিধিরা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আসছে বছর,আবারো একটি কনফারেন্সের মাধ্যমে নতুন কিছু খসড়া প্রণয়ন করা হবে। আর বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু হবে ২০২০ সাল নাগাদ,এমনটাই তাদের প্রত্যাশা।
২০০১সালে COP7 এ উঠে আসা বহুল আলোচিত চুক্তি; কিয়োটো প্রটোকলের পর ফ্রান্সের প্যারিসে,২০১৫ সালে নতুন চুক্তি গৃহিত হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু সেই খসড়া প্রণয়ণ নিয়েই হুলস্থুল কান্ড ঘটে গেলো সম্মেলনের এইক’টা দিন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায়,গ্রীনহাউস গ্যাসনিঃসরণ কমানোটাই মূল লক্ষ্য।সেই মোতাবেক কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে অনেকদিন থেকেই আলোচনা,সমালোচনা হয়ে আসছে।বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলো সবচেয়ে বেশি হুমকির মধ্যে পড়ছে।ঘূর্ণিঝড়,জলোচ্ছ্বাস এর মত ভয়ংকর রূপ নেয়া দুর্যোগ গুলোর আঘাত হানার ঘটনা যেন এখন প্রায় নৈমিত্তিক ব্যাপার।কিন্তু এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মূল শেকড়টা কোথায়? সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিরা সেই ইঙ্গিতের আঙ্গুল তুলেধরলো উন্নত দেশগুলোর দিকে।গবেষনায় নিঁখুতভাবে প্রমাণিত,অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলার জন্য উন্নত দেশগুলো তাদেরশিল্প কারখানার উৎপাদন বাড়াতে আগ্রহী,আর তাই কার্বন নিঃসরণ ও করছে সবচেয়ে বেশি তারাই।আলোচনায়,২০২০ সালের মধ্যেই উন্নত দেশগুলোর প্রতি কার্বণ নিঃসরণ কমানোর একটি লক্ষ্য মাত্রা ঠিক করার কথা ছিলো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা ২০১৫ সালের প্রথমদিকে এ বিষয়ে তাদের পরিকল্পনা জানাবে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধি হেডেগার্ড এই চুক্তি গ্রহণের সময়সীমার প্রতি হতাশা প্রকাশ করেন।
তিনি মনে করেন,কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য এই সময়সীমা যথেষ্ট নয়। এদিকে চীন –এর প্রধান মধ্যস্থতাকারী সুওয়েই বলেন,শুধুমাত্র উন্নত দেশগুলোকেই প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।উন্নয়নশীল দেশগুলো সহায়তা করবে,তবে নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী।অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন একইসাথে উদ্বেগ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি,বিশেষকরে চীন কে উদ্দেশ্য করেই যেন তারা প্রশ্ন তুললো।বিশ্বের ২য় বৃহত্তম মিতব্যয়ী এবং সবচেয়ে বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারী দেশ চীনের উচিত এই দায়ভার গ্রহণ করা,যেহেতু তারা কিয়োটো প্রটোকলের অধীনে ও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আলোচনার এক পর্যায়ে এই চুক্তির প্রতি দ্বিমত পোষণ করে জাপান।তারা সাফ সাফ জানিয়ে দেয়,২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা তাদের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হবেনা। কেননা,২০১১ সালে জাপানের সর্ববৃহৎ ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে তা্দের জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে কার্বন নিঃসরণ অনেক বেশি পরিমাণে হলেও,তা কমাতে আশুব্যাবস্থা গ্রহণ করতে তাদের আরো অনেক সময় লাগবে বলে জানিয়েদেয় তারা।
এদিকে উন্নত দেশগুলোর এ ধরণের বিরূপ ও স্বার্থান্বেষী আচরণে ভেঙ্গে পড়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। ক্ষুব্ধ হয়ে কেউ কেউ ওয়াকআউটকরে।আর এরুপ হাঙ্গামা তৈরীর কারণে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ জনগণ।তারা প্ল্যাকার্ডে ও শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর করে তোলে বাইরের পরিবেশ।
এদিকে পরিবেশবাদী জোট ‘গ্রীনগ্রুপ’ অসন্তুষ্টি ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে,কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তৈরী হওয়া সংকট নিরসনে অর্থনৈতিক সমাধান কী করে হবে,সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট অঙ্গীকার নেয়া হয়নি এ বারের আলোচনায়। এছাড়াও বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রী কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে গত বুধবারে রাতভর আলোচনা হয় কিন্তু কোনো চুক্তি না হওয়ায় ১৩ টি বেসরকারী পরিবেশ সংগঠনের ৮০০ প্রতিনিধি সম্মেলন ছেড়ে বেরিয়ে যান। এতোকিছুর পর কোনো অগ্রগতি না হওয়ার কারণে সম্মেলনের সময় বাড়ানো হয় আরো একটি দিন। অতঃপর শেষ দিনে এসে কিছু বিষয়ে তারা একমত হতে পেরেছেন,এটাই এবারের সম্মেলনের একমাত্র আশার আলো।
সম্মেলনের শেষ দিনে এসে এমন একটি বিষয়ে তারা একমত হয়েছেন,যা বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করছেন সম্মেলনের প্রতিনিধিরা। তাহলো বনাঞ্চল রক্ষায় দরিদ্রদেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর সরকার ও সংস্থাগুলো অর্থ প্রদান করে সহায়তা করবে। আর বনাঞ্চল রক্ষা করা গেলে কমবে কার্বন নিঃসরন,সাথে সাথে কমবে বৈশ্বিক উষ্ণতাও। তাই এবারের সম্মেলনের একটি বড় প্রাপ্তি বলে ধরা হচ্ছে এটিকে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হিসেবে,এরই মধ্যে নরওয়ে সরকার ইন্দোনেশিয়া,ব্রাজিল ও গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোকে১.৪বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়েছে। তাই এই নবনির্মিত চুক্তিকে ব্রিটিশ জ্বালানীমন্ত্রী এড ডেভি একটি মাইলফলক হিসেবেই দেখছেন।
এছাড়াও আলোচকেরা ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ভবিষ্যৎ ক্ষতি মোকাবিলায় সহায়তা করতে ‘ওয়ারশ ইন্টারন্যাশনাল মেকানিজম ফর লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ প্রণয়নে সম্মত হন।
পুনরাবৃত্তি ঘটনার মধ্যদিয়ে প্রায় শেষ হতে চলা ‘বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন’২০১৩ যেন পোল্যান্ডের মাটিতে আরো একটি হতাশা ও স্বার্থপরতার সাক্ষর রাখতে চলেছিলো। শোষক-শোষিতের সেই চিরাচরিত রূপের স্পষ্টতা, ওয়াক আউট,জনগণের প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভ,মত-পার্থক্যের যুদ্ধের জোয়ারে মূল উদ্দেশ্য থেকেই সরে আসা,অতঃপর কারো বাগোমড়া মুখে বাড়ি গমন,কারো বা তৃপ্তির হাসি ফুঁটিয়ে বাড়ি ফেরা…এই সব কিছুর ও যেন একটু ভিন্ন মোড় তৈরী হলোনা নান নাটকীয়তা শেষে সম্মেলনের বর্ধিত শেষ দিনের নাটকীয়তায়। ঐদিনেই এমন একটি চুক্তির খসড়া তৈরী হলো,যা কিনা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো ঝরে পড়লো সম্মেলনে আসা প্রতিনিধি দেশগুলোর উপর শুভ বার্তা হয়ে।এখন আবার অধীর আগ্রহে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকা; সামনের বছরের দিকে। পেরুর লিমায় কী ঘটবে? নতুন কোনো মাইলফলক নাকি আবারো কোনো নতুন নাটক?