বিলীন হচ্ছে উপকূলের 'প্রাকৃতিক দেয়াল'
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিলীন হচ্ছে ‘প্রাকৃতিক দেয়াল’ হিসাবে পরিচিত পটুয়াখালীর কুয়াকাটা ও গঙ্গামতি সমুদ্র সৈকতের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গড়ে উঠা সবুজ বনাঞ্চল। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ও বনবিভাগের রোপণকৃত কয়েকশ’ প্রজাতির গাছের এই বাগানের সৌন্দর্য পর্যটকদের বার বার টেনে আনে এই সৈকতে। ভয়াবহ বন্যা, প্রলয়ংকরী সিডর ও আইলার তাণ্ডব থেকে এই ‘প্রাকৃতিক দেয়াল’ স্থানীয়দের জীবন বাঁচালেও আজ তাদের নিজের জীবনই ঝুঁকির মুখে। আর এ কারণে হুমকির মুখে পড়েছে উপকূলীয় এলাকার লাখো মানুষের নিরাপত্তা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সাগরের পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা বৃদ্ধির সাথে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিন একটু একটু করে ধ্বংস হচ্ছে মনোমুগ্ধকর এই সবুজ বনায়ন। জোয়ারের সময় সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে সৈকতের বালুর স্তর প্রতিদিনই ৫/১০ ইঞ্চি পর্যন্ত নেমে যাওয়ায় গাছের কাণ্ড ভেঙ্গে পড়ছে, আবার কোন কোন গাছের শিকড় বের হয়ে যাওয়ায় এসব গাছ খাদ্য সংগ্রহ করতে না পারায় মরে যাচ্ছে। অনেক গেওয়া, কেওড়া, ছইলা ও নারিকেল গাছের কাণ্ড ভেঙ্গে গেছে। আবার অনেক গাছের পাতা ও কাণ্ড বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে, আগামী দু-এক বছরের মধ্যে সমুদ্র পাড়ের এসব গাছ মরে যেতে পারে। তখন প্রকৃতি-পরিবেশে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে। এতে মানুষের বসবাসে চরম বিপর্যয় দেখা দেয়ার আশংকা করছেন এলাকাবাসী।
কুয়াকাটা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বাদশা মিয়া প্রায় ৩৬ বছর ধরে সাগরে মাছ শিকার করেন। তিনি জানান, ‘সাগরের ঘূর্ণি ঢেউয়ের কারণেই এ্যাহন সাগর পাড় খালি ভাঙ্গছে আর ভাঙ্গছে।’ মম্বিপাড়া গ্রামের কৃষক বেলাল হোসেন (৪৯) জানান, ‘এইতো হেইদিনও সাগর পাড়ে হাজার হাজার গাছ ছিল। সাগরের পাড় জুড়ে ছিল গুল্মলতায় ঘেরা। মাত্র কয়ডা বছরেই বাগানগুলো সাগরে বিলীন হয়ে গেছে।’
স্থানীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ষাটের দশকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে গঙ্গামতি, কুয়াকাটার সৈকত লাগোয়া বালুচরে ম্যানগ্রোভ জাতের বৃক্ষের বনায়ন করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গেওয়া, কেওড়া ও ছইলা গাছ। ওই সময় ১১০০ একর ভূমিতে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বাগান করা হয়েছিল। বন বিভাগের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, কুয়াকাটা ও গঙ্গামতি সৈকত এলাকার প্রায় ২০ হাজার গেওয়া, কেওড়া ও ছইলা গাছ বর্তমানে চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
সমুদ্রের পানির প্রচণ্ড লবণাক্ততায় এসব গাছ মরে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। এ ছাড়া প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটায় মাটির স্তর ধুয়ে নেমে যাওয়ায় প্রতিদিনই ভেঙ্গে পড়ছে গাছ। এছাড়া সমুদ্রের পানি বিষাক্ত হওয়ায় বৃক্ষরাজি, মাটি ও বালি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে গাছের পাতা হলুদ হয়ে যাচ্ছে ও গাছের মূল ধূসর বর্ণের হয়ে ক্রমান্বয়ে মরে যাচ্ছে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবিএম মাহাবুব মোর্শেদ এর সত্যতা স্বীকার করে এই প্রতিনিধিকে জানান, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বরফ গলে সাগর-নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে। সেই সাথে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ৫০/৬০ বছর পূর্বে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও বন বিভাগের লাগানো বনাঞ্চল বিপরীত প্রতিকূলতায় এখন মরে যাচ্ছে। আরো বেশি করে গাছ লাগালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলের মানুষ রক্ষা পেতে পারে বলে তার অভিমত।
কলাপাড়া বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা খোন্দকার ইয়াকুব আলী জানান, প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের মধ্যে সাগরের জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় বালুর স্তর নেমে গাছগুলো মরে যাচ্ছে। এছাড়া সাগর ও নদীর ঢেউয়ের তোড়ে ভূমি ক্ষয়ের কারণে ভেঙ্গে পড়ছে হাজার হাজার গাছ। তিনি বলেন, লবণাক্ততার কারণেই বেশি গাছ মারা যাচ্ছে। এজন্য সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় লবণ সহিষ্ণু গাছ রোপণ করলে এর প্রভাব থেকে উপকূলীয় এলাকার মানুষ রক্ষা পেতো। এজন্য সবাইকে বেশি করে গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন তিনি।
http://ittefaq.com.bd