বিপন্নতার মুখে সুন্দরবন
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সুন্দরবন। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এটি দেয়াল হয়ে রক্ষা করে আমাদেরকে। কিন্তু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্হাপিত হলে বিপন্ন হবে এই বন। হুমকির মুখে পড়বে মানুষ ও প্রাণবৈচিত্র্য।
সুন্দরবন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লোনা পানির জঙ্গল। গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটারজুড়ে এর অবস্হান। ১৯৯৭ সালে এই বন ঠাঁই করে নেয় ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায়। এর পাঁচ বছর আগে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পায় এই বাদাবন। বনটির অর্ধেকেরও বেশি (প্রায় ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার) বাংলাদেশে আর বাকিটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। দুই বাংলার এই অভিন্ন জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল বিভিন্ন কারণে আজ হুমকির মুখে। বাংলাদেশ অংশে অবাধে গাছ কাটা, বাঘ আর হরিণ শিকার, অবৈধভাবে বিভিন্ন বনজ সম্পদ আহরণ- সব মিলিয়ে সুন্দরবনের টিকে থাকাটাই যখন সময়ের ব্যাপার, তখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র।সুন্দরবনের ঠিক ১৪ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটের রামপালে স্হাপিত হতে যাচ্ছে এই তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। সরকারি নথিপত্রে ১৪ কিলোমিটার দূরত্বে দেখানো হলেও সম্প্রতি একটি জিপিএস কো-অর্ডিনেশনে একে সুন্দরবন থেকে সাড়ে নয় কিলোমিটার দূরত্বে দেখাচ্ছে। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে দ্বিতীয় দফা চুক্তি হয় ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি ও বাংলাদেশের পিডিবির মধ্যে। পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া প্রকল্পের স্হান চূড়ান্ত করা, জমি অধিগ্রহণ, চুক্তি সম্পাদন করে তারপর পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণের হাস্যকর উদ্যোগে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে। বাংলাদেশ সরকারের প্রচলিত আইন অনুযায়ী কোনো সংরক্ষিত এলাকার ১০ কিলোমিটার ব্যাসের মধ্যে শিল্পকারখানা স্হাপন করা যাবে না। অধিকন্তু বন অধিদপ্তরের আপত্তিও ধোপে টেকেনি।
রামপালে কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে পানির জোগান আসবে পশুর নদ থেকে। এই পানিপ্রবাহের ওপর টিকে রয়েছে সুন্দরবনের প্রাণিবৈচিত্র্য আর আশপাশের গ্রামবাসী। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে গ্রামের কৃষিকাজে সেচের পানি মিলবে না। সেখানকার আটটি ইউনিয়নের অন্তত আট হাজার পরিবার এই ক্ষতির শিকার হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা যে দেশ থেকেই আনা হোক না কেন, পরিবহন করা হবে জাহাজে, আর তা সুন্দরবনের মধ্য দিয়েই। এ ছাড়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, বিভিন্ন রাসায়নিক ক্ষুদ্র কণিকা, কার্বন মনোক্সাইড, মার্কারি, আর্সেনিক, সিসা, ক্যাডমিয়ামসহ পরিবেশ ও মানবস্বাস্হ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদানগুলো নির্গত হয়। এর বাইরে আরও একটি সমস্যা হলো ছাই। বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা পুড়ে ছাই হয় এবং তা পানির সঙ্গে মিশে তৈরি হয় তরল কয়লাবর্জ্য। এটি বিষাক্ত। কারণ, এতে আর্সেনিক, মার্কারি, ক্রোমিয়াম এমনকি তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম থাকে।
রামপালে স্হাপিত হতে যাওয়া এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভবিষ্যৎ ক্ষতি নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্হাপিত হলে পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে এলাকার পানি, বাতাস ও মাটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এলাকার পানি শতভাগ, বাতাস ৯০ ভাগ ও মাটি ৬৫ ভাগ দূষিত হয়ে পড়বে। মাটির লবণাক্ততা আর বাতাসের তাপমাত্রা বাড়বে। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াই এখন যে দূষণ চলছে, তাতে একই সময়ে এই দূষণ হতে পারে শতকরা ২০ ভাগ আর বাতাসের ক্ষেত্রে ১৫ ভাগ।
সরকারের সমীক্ষাতেই স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, কয়লাবাহী জাহাজ চলাচলের ফলে জাহাজ থেকে কয়লার গুঁড়া, ভাঙা/টুকরো কয়লা, তেল, ময়লা আবর্জনা, জাহাজের দূষিত পানিসহ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নিঃসৃত হয়ে নদী-খাল-মাটিতে মিশবে। একই সঙ্গে চলাচলকারী জাহাজের ঢেউয়ে দুই পাশের তীরের ভূমি ক্ষয় হবে। এ ছাড়া কয়লাবাহী জাহাজ ও কয়লা লোড-আনলোড করার যন্ত্রপাতি থেকে দিনরাত ব্যাপক শব্দদূষণ হবে। রাতে জাহাজের সার্চ লাইটের আলো নিশাচর প্রাণীসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবনের পশুপাখির জীবনচক্রের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহনের এসব ফল বর্ণনা করে সমীক্ষায় আবার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে, জাহাজ চলাচলের আন্তর্জাতিক আইন, বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ইত্যাদি মেনে জাহাজ ধীরগতিতে চলাচল করলে, অপ্রয়োজনে শব্দ এবং সার্চ লাইটের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করলেই না-কি এসব ভয়ংকর ক্ষতি এড়ানো যায়!
সমীক্ষা থেকে আরও জানা যায়, ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে। এই বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে সালফার আর নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে সুন্দরবনকে ধ্বংস করে ফেলবে। প্রস্তাবিত এই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সঠিক প্রমাণ করতে সরকার যে ঢাল ব্যবহার করছে, তা হলো সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির ব্যবহার। যদিও এর ফলে সাধারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় মাত্র ১০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড কম নির্গত হবে। প্রতিবছর এই কেন্দ্র থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমনের পরিমাণ হবে ৭৯ লাখ টন, যা সমীক্ষায় একবারও উল্লেখ করা হয়নি। পশুর নদ থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৯১৫০ ঘনমিটার পানি প্রত্যাহার করা হবে বলে সমীক্ষায় জানানো হয়েছে। পশুর নদের পানিপ্রবাহের ওপর তা কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে সমীক্ষায় কোনো আলোচনা নেই।
কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পানি নির্গত হলে তাতে দূষণকারী উপাদান থাকবেই, ফলে পৃথিবীর সব দেশে এমনকি ভারতেও ‘শূন্য নির্গমন’ নীতি অনুসরণ করা হয়। এনটিপিসিই যখন ভারতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্হাপন করে তখন ‘শূন্য নির্গমন’ নীতি অনুসরণ করে, অথচ বাংলাদেশের সরকারি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পরিশোধন করার পর তরল বর্জ্য ঘণ্টায় ১০০ ঘনমিটার হারে পশুর নদে নির্গত হবে, যা সুন্দরবনকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। এর বাইরে স্বাস্হ্যগত ঝুঁকি তো রয়েছেই- সালফার, নাইট্রোজেন, কার্বন ইত্যাদির বিভিন্ন যৌগ ও পারদ, সিসা, ক্যাডমিয়াম, ব্যারিয়াম ইত্যাদি ভারী ধাতুর দূষণে ব্যাপক হারে ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ হতে পারে।
সুন্দরবন ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রাচীর হয়ে দেশের বিপুল সম্পদ ও প্রাণ রক্ষা করে। উপকূলীয় কয়েক লাখ লোকের জীবিকার মূল অবলম্বন এটি। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, গাছপালা প্রাকৃতিক ইতিহাসের অনন্য পাঠশালা। আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের শেষ আশ্রয় এই সুন্দরবন। তাই একে রক্ষার লড়াইটা নিজেদেরই করতে হবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে- বিদ্যুৎ আমাদের অবশ্যই প্রয়োজন, তা মেটাতে হবে সুন্দরবনের ক্ষতি না করেই।
আল মারুফ রাসেল
লেখকঃ গণমাধ্যম কর্মী, এবং সুন্দরবন বিষয়ক গবেষক
ছবি: লেখক