বাইক্কা বিলে বালি হাঁস এবারও ডিম দিয়েছে
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
ডিমগুলোর রং ধবধবে সাদা। বালিহাঁসের ডিম! কোনো কোনোটি ফুটে ইতিমধ্যে ছানা বেরিয়ে এসেছে। ফুটফুটে ছানাগুলো মুক্তপৃথিবীর আলোতে বেরিয়েই নেমে পড়ছে পানিতে। সাঁতরে বেড়াচ্ছে আপন মনে। বালিহাঁসের এই ছানাগুলো সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বাইক্কা বিলের। বিলের সবুজ প্রকৃতি আর জীববৈচিত্র্য ওদের বরণ করে নিতে বুঝিবা হাত বাড়িয়েই আছে। বিলপারের পারের মানুষের গভীর সহানুভূতি ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত হলেই ওরা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠবে। বংশবিস্তার ঘটবে নানা প্রতিকুলতায় ঝুঁকির মুখে থাকা বালিহাঁসের। ক্রমাগত শিকার আর প্রজননে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে বালিহাঁস এখন বিপন্ন প্রজাতির তালিকাভুক্ত পাখি। সাধারণত বড় গর্তবিশিষ্ট পুরনো গাছ, নদীর ধারের পোড়ো বাড়ি, মঠ, মন্দির এসব স্থানেই ওরা বাসা বাঁধে। উপযোগী আবাসের অভাবে এখন বালিহাঁস সফলভাবে বংশবিস্তার ঘটাতে পারছে না।
এমনই অবস্থায় বালিহাঁসের প্রজনন রক্ষায় একটি প্রকল্পের আওতায় ২০০৬ সালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলের পারে ১০টি বাক্স স্থাপন করা হয়। সেই বছর বালিহাঁস তাতে বাসা না বাঁধলেও ২০০৭ সাল থেকে ওরা বাক্সে বাসা বেঁধে ডিমে তা দিয়ে ছানা ফোটাতে শুরু করে। চলতি বছরও বাইক্কা বিলে বালিহাঁসের প্রজনন রক্ষার উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখল। এবারও বিলের বিভিন্ন অংশে কৃত্রিমভাবে স্থাপন করা কাঠের বাক্সে ডিম দিয়েছে বালিহাঁস। এখন চলছে ডিমে তা দিয়ে ছানা ফোটানোর কাজ। বিলের পাড়ে হিজল-করচ বনে স্থাপিত ২১টি বাক্সের চারটিতে পাওয়া গেছে বালিহাঁসের ডিম।
ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে পরিচালিত পরিবেশের ভারসাম্য, বাস্তু ও জীবনধারণ প্রকল্পের (ক্রেল) আঞ্চলিক সমন্বয়কারী মাজহারুল ইসলাম জাহাঙ্গীর বলেন, ‘গত ৩ সেপ্টেম্বর আমরা বাইক্কা বিলে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি স্থাপিত ২১টি বাক্সের চারটিতে বালিহাঁস ডিম পেড়ে তাতে তা দিচ্ছে। আরো দু-তিনটি বাক্সে ডিমের খোলস পাওয়া গেছে। বিলের পানিতে বালিহাঁসের ছানাদের সাঁতার কাটতেও দেখা গেছে। আর অন্য বাক্সগুলোতে বাসা বেঁধেছে শালিক ও পেঁচা প্রজাতির পাখি।’ মাজহারুল ইসলাম জাহাঙ্গীর আরো বলেন, ‘বালিহাঁস সাধারণত ছয় থেকে ১০টি ডিম দিয়ে থাকে। আমরা একটি বাক্সে ১৬টি ডিম দেখেছি। বাইক্কা বিলের জীববৈচিত্র্য অনুকূলে থাকায় বালিহাঁসের প্রজনন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিকশিত হচ্ছে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য দিক। আগামী মৌসুমে বাইক্কা বিলে আরো কিছু বাক্স স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’
পাখি ও পরিবেশবিষয়ক গবেষক সৌরভ মাহমুদ বলেন, “বালিহাঁসকে ‘ধলা বালিহাঁস’ ও ‘ভুলিয়া হাঁস’ নামে ডাকা হয়ে থাকে। ইংরেজি নাম Cotton Pygmy Goose, বৈজ্ঞানিক নাম Nettapus Coromandelianus। ছেলে ও মেয়ে বালিহাঁসের আকার ও বর্ণে পার্থক্য রয়েছে। ছেলে বালিহাঁসের মাথায় চাঁদি ও পিঠ কালচে বাদামি। মুখ, ঘাড় ও দেহতল সাদা। গলায় কালো বলয় রয়েছে। আর মেয়ে বালিহাঁসের দেহতল অনুজ্জ্বল ফিকে সাদা। ডানার প্রান্ত সাদা। ছেলেমেয়ে উভয় পাখির পা ও পায়ের পাতা কালচে বাদামি।”
তিনি জানান, ‘বালিহাঁসের বিচরণক্ষেত্র জলজ উদ্ভিদ ভরা হ্রদ, হাওর, বড় পুকুর ও জলাবদ্ধ ধানক্ষেত। এদের সাধারণত পাঁচ থেকে ১৫টির ছোট ছোট দলে দেখা যায়। পানিতে ভাসমান জলজ উদ্ভিদ থেকে এরা খাবার সংগ্রহ করে। জলজ উদ্ভিদের কচিকা ও বীজ, চিংড়ি ও কাঁকড়া জাতীয় প্রাণী, পোকামাকড়ও খায়। ডানা ঝাপটে চলার সময় পত্পত্ শব্দ হয়। জুন-সেপ্টেম্বর মাসে প্রজনন ঋতুতে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসতে ১৫-১৬ দিনের মতো সময় লাগে।’
বাইক্কা বিলে স্থাপিত কাঠের বাক্সগুলোর উচ্চতা সাড়ে ২৩ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ও গভীরতা সোয়া ৯ ইঞ্চি। প্রবেশমুখের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সাড়ে চার ইঞ্চি ও সাড়ে তিন ইঞ্চি। ব্যবহৃত কাঠের পুরুত্ব দশমিক ৭৫ ইঞ্চি।
লেখক : প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক এবং
দৈনিক কালের কণ্ঠের শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
সূত্র : ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠ