বাংলার চিত্রা হরিণ…………
চিত্রা হরিণ, চিত্রল হরিণ, চিত্র মৃগ বা চিতল (Axis axis) সম্ভবত উপমহাদেশীয় হরিণ প্রজাতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর। এর ইংরেজী chital (বা cheetal) নামটি এসেছে বাংলা চিত্রা বা চিত্রল থেকে, যার অর্থ ফোঁটা বা ছোপযুক্ত। ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানের বনাঞ্চলগুলো চিত্রা হরিণের স্থায়ী আবাসস্থল। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিত্রা হরিণ ছাড়া হয়েছে। এর দুটি উপপ্রজাতি রয়েছে- Axis axis axis (ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানে দেখা যায়) ও Axis axis ceylonensis (শ্রীলঙ্কান চিত্রা হরিণ, কেবল শ্রীলঙ্কায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে ছাড়া হয়েছে)।
আবাসস্থল: ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানে চিত্রা হরিণ দেখা যায়। ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও বাংলাদেশের নিঝুম দ্বীপে চিত্রা হরিণ অবমুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া আর্জেন্টিনা, আর্মেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইউক্রেন, উরুগুয়ে, ব্রাজিল, ক্রোয়েশিয়া, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউগিনি, মলদোভা ও যুক্তরাষ্ট্রে (টেক্সাস ও হাওয়াই) এদের অবমুক্ত করা হয়েছে।
শারীরিক গঠন: চিত্রা হরিণের দেহ লালচে বাদামী লোমযুক্ত চামড়া দ্বারা আবৃত যাতে সাদা সাদা ফোঁটা দেখা যায়। ফোঁটাগুলো ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত না থেকে আনুভূমিক রেখার উপর অনিয়মিতভাবে বিন্যাস্ত রয়েছে বলে মনে হয়। গলার নীচে, পেট, লেজের নীচে ও চার পায়ের ভেতরের চামড়ার বর্ণ সাদা। হাঁটু থেকে পায়ের খুর অবধি হাল্কা সাদা বা ধুসর রং রয়েছে।এদের কাঁধ বরাবর একটি গাঢ় রেখা পিঠ দিয়ে লেজ পর্যন্ত চলে গিয়েছে। পুরুষ হরিণের রেখাটি অধিক দৃশ্যমান আর গাঢ় হয়। পূর্ণবয়স্ক চিত্রা হরিণের কাঁধ পর্যন্ত উচ্চতা ৩০ থেকে ৩৮ ইঞ্চি হয়। দেহ লম্বায় ৪২ থেকে ৫৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। লেজের দৈর্ঘ্য ৮ থেকে ১২ ইঞ্চি। ওজন ৭৫ থেকে ১০০ কেজি (১৬৫ থেকে ২২০ পাউণ্ড) পর্যন্ত হয়। পুরুষ হরিণের উচ্চতা ও ওজন স্ত্রী হরিণের চেয়ে বেশী হয়। কেবলমাত্র পুরুষ হরিণের শিং থাকে। সাধারণ শিঙের দৈর্ঘ্য ২২ থেকে ২৭ ইঞ্চি হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে ৭৫ ইঞ্চি (প্রায় আড়াই ফুট) পর্যন্তও হয়। শিং শাখা-প্রশাখা যুক্ত, সর্বমোট তিনটি শাখা দেখা যায়। হরিণের শিং অনেকসময় পড়ে যায় আর আবার গজায়। শিং গজানো এবং শিং পড়ে যাবার সময়সীমা এক অঞ্চলে একেক রকম। বয়স এবং খাদ্যের উপরও শিং বেশী দিন থাকা বা পড়ে যাওয়া বা লম্বা হওয়া নির্ভর করে। পুরুষ হরিণের ঘাড় সরু ও বুক তুলনামূলক স্ফীত থাকে। পুরুষ হরিণের মুখে গাঢ় চিণ্হ থাকে যা দ্বারা এদের বয়সও নির্ধারণ করা যায়।
খাদ্যাভ্যাস: ঘাস, গুল্ম আর গাছের পাতা চিত্রা হরিণের প্রধান খাদ্য। গাছের বাকল ও মূলও এরা খায়। বানর ও হনুমান অনেকসময় গাছের ডালপালা ও ফল নীচে ফেলে আর এরা তা খায়। এরা পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায় আর গাছের নিম্নবর্তী ডালগুলো থেকে কচি পাতা ছিঁড়ে খায়। পুরুষ হরিণের ক্ষেত্রে এ অভ্যাসটা বেশি দেখা যায়। অনেকসময় এরা এদের পড়ে যাওয়া শিংও খায়। সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ মূলত কেওড়া, বাইন, গেওয়া, ওড়া, গরান, এবং কাঁকড়া গাছের ছোট চারা ও কচি পাতা এমনকি ছাল (বাকল) খেয়ে থাকে।
চিত্রা হরিণ খুব ভাল পোষ মানে। পোষা হরিণ বিভিন্ন ধরণের সব্জী খেয়ে থাকে। বাঁধাকপি, বরবটি, শিম ইত্যাদি সব্জী খুব মজা করে খায়।
প্রজনন: চিত্রা হরিণের প্রজননের জন্য নির্দিষ্ট কোন সময় নেই।উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে চিত্রা হরিণ বংশবৃদ্ধি করে। তবে বর্ষার পূর্বে যখন সবুজ ঘাসের সমারোহ ঘটে এবং গাছের চারা ও লতা-পাতায় বন ছেয়ে যায় তখনই বাচ্চা প্রসবের প্রকৃষ্ট সময়।প্রজনন ঋতুতে পুরুষ চিত্রা হরিণ উত্তেজিত হয় ও দলে একাধিক পুরুষ হরিণ থাকলে তারা একের সাথে অপরের শিং ঠেকিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রচন্ড লড়াইয়ের সময় অনেক সময় শিং ভেঙে যায় বা খসে পড়ে।
চিত্রা হরিণী ২১০-২২৫ দিন গর্ভধারণের পর একটিমাত্র বাচ্চা প্রসব করে। শিশু হরিণ ৬ মাস পর্যন্ত স্তন্য পান করে।
স্ত্রী হরিণ ১৪-১৭ মাসে (কারো কারো মতে ১০ মাসে) বয়োঃপ্রাপ্ত হয়। অপরদিকে পুরুষ হরিণ ১৪ মাসে বয়োঃপ্রাপ্ত হয়।