বাঁচাতে হবে রাজধনেশ

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

লম্বা ঠোঁটে তার দৃষ্টিকাড়া সৌন্দর্য। শরীরজুড়েও সাদা, কালো ও হলুদ রঙের অপূর্ব সংমিশ্রণ। চোখের পাতার নিচে চুল, অনেকটা মানুষের মতোই। এমন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে অন্য সব পাখি থেকে সহজেই আলাদা করে চেনা যায়।

রাজধনেশ – বাংলাদেশে বিচরণকরা বৃহত্তম পাখিগুলোর অন্যতম একটি। ইংরেজি নাম ‘Great Hornbill’, আর বৈজ্ঞানিক নাম ‘Buceros bicornis’। বিশালতার দিক থেকে শকুন, মদনটাকের মতোই দেখতে। আমাদের অদূরদর্শিতায় অপূর্ব পাখিটি আজ উঠে এসেছে বিলুপ্তির তালিকায়। পাখিটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সচেতন হতে হবে জনগণকেও। দূর করতে হবে ওদের বেঁচে থাকার পথের প্রতিবন্ধকতাগুলো।

এককালে দেশে যে চার প্রজাতির ধনেশের উপস্থিতি ছিল, এদের সবাই দীর্ঘ ঠোঁটের অধিকারী। পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় আকারের পাখিরা দেশ থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ দৈহিক আকার অনুযায়ী এদের খাবারও লাগে বেশি। পাশাপাশি প্রয়োজন পড়ে বড় বিচরণভূমি। আমাদের দেশে পাখির বিচরণভূমিগুলো ছোট। আর আকারে বড় হওয়ায় এগুলো সহজেই মানুষের নজরে চলে আসে। শিকারির লোলুপ দৃষ্টি এদের আরো বিপন্ন করে তোলে।

স্বনামধন্য পাখি গবেষক ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক রাজধনেশ সম্পর্কে বলেন, ‘প্রজনন মৌসুমে ছেলে পাখিটির কর্তব্য অনেকখানি বেড়ে যায়। ওরা বড় বড় পুরনো গাছের কোটরে বাসা করে। সেখানে ওদের ডিম ও ছানা খেয়ে ফেলার জন্য সাপসহ নানা সরীসৃপ ঘোরাফেরা করে। সেসব শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতে সে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। মেয়ে ধনেশটা ডিম পাড়তে শুরু করলে ছেলে ধনেশ ডোবা-নালা থেকে মুখে করে কাদা এনে দেয়াল তুলে কোটরের মুখ অনেকটাই বন্ধ করে দেয়। মাঝে যে ছোট ছিদ্র রাখে তা দিয়ে শত্রুরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। ওই ছিদ্র দিয়েই সে খাবার সংগ্রহ করে এনে ভেতরে ডিমে তা দেওয়া মেয়ে পাখিটিকে খাওয়ায়। ডিম ফুটে ছানা হলে ছানাগুলোকেও খাবারের জোগান দেয়। দেড় থেকে দুই মাস ধরে সে একাই এসব কাজ করে যায়। এ সময়টাতে প্রচণ্ড গরমের কারণে গর্তের ভেতরে থাকা মেয়ে পাখিটির সব পালক ঝরে যায়। গর্তের ভেতরে পালক খসে পড়ার ফলে সে আর উড়তে পারে না। সে তখন অসহায় হয়ে পড়ে এবং ছেলে পাখিটির ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। তারপর একসময় ছানাগুলো বড় হয়ে ওঠার পর গাছের কোটরের ওই মাটির দেয়ালটি ভেঙে ফেলা হয়। ধীরে ধীরে মা ও ছানাদের পালক গজায় এবং তারা ওই গর্ত থেকে উড়ে বেরিয়ে পড়ে।’Srimangal Pic_Raj-Dhonesh

ইনাম আল হক আরো বলেন, ‘রাজধনেশ বাংলাদেশের মহাবিপন্ন একটি পাখি। অর্থাৎ খুব অল্পদিনের মধ্যেই পাখিটি চিরতরে হারিয়ে যাবে। একসময় পাহাড়ি এলাকা ছাড়া এদের অন্য কোথাও আর দেখা যাবে না। সর্বশেষ ১৯৯৫ সালে পাখিটিকে আমি শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে দেখেছিলাম। অথচ একসময় বাংলাদেশে পাখিটি হাজারে হাজারে ছিল। কিন্তু অবহেলার জন্য এই পাখিটিকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি।’ তিনি বলেন, ‘পাখিটির একটা বড় অসুবিধা হলো, দৈহিকভাবে বড় হওয়ায় নিতান্ত মাংসের লোভেই পাহাড়ি অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পাখিটিকে মেরে খেয়ে ফেলে। পার্বত্য চট্টগ্রামে গেলে দেখা যায়, হাতে তীর-ধনুক ও বন্দুক নিয়ে ওরা সারা দিন বনে বনে ঘুরে এসব বিপন্ন প্রাণী হত্যা করছে। দেখেছি, ওরা রাশধনেশ মেরে খেয়ে পাখিটির ঠোঁট ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছে। একেকটি ঘরে অনেক ঠোঁট খুঁজে পেয়েছি। তার মানে অনেক রাজধনেশ ওরা মেরেছে। ফলে এই পাখি দ্রুতই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।’

ইনাম আল হক আরো বলেন, ‘বড় বড় গাছ সব কেটে ফেলা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনেও একই অবস্থা। ফলে রাজধনেশ বাসা করার মতো কোনো কোটর বা ফাটল পাচ্ছে না। ফলে ওরা বংশবৃদ্ধি করতে পারছে না। আমরা একটু সচেতন হলেই পাখিটি রক্ষা করা সম্ভব। এখন লাউয়াছড়া ও সাতছড়ির মতো সংরক্ষিত বনেই আমরা যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে ওদের টিকিয়ে রাখতে পারব বলে আশা করতে পারি। আমার ধারণা, লাউয়াছড়ায় এই প্রজাতির সর্বশেষ দু-একটি পাখি থেকে যেতে পারে। ওরা গাছের কোটরে বাসা বাঁধে এবং বনের ফল খায়। ওরা যে ধরনের ফল খায় সেই গাছগুলো এখনো লাউয়াছড়ায় আছে। ওরা পাহাড়ি গাছের ফল খায়। আম-জাম-কাঁঠালের মতো ফল মুখে নেয় না। পাখিটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সরকারের উদ্যোগ জরুরি হয়ে পড়েছে। আশা করা হচ্ছে, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বাংলাদেশে পাখিটির ওপর শিগগির জরিপ পরিচালনা করবে।’

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সূত্রে জানা যায়, রাজধনেশের দৈর্ঘ্য ১৩০ সেন্টিমিটার এবং ওজন গড়ে তিন কেজি। ছেলে পাখির ঠোঁটের সামনের অংশ ও খাঁজ কালো, চোখ রক্তলাল। মেয়ে পাখির চোখের পাশের চামড়া লাল, ঠোঁটের ওপরে অতিরিক্ত অংশটির পেছনটা লাল। জোড়ায় বা তিন থেকে পাঁচটি পাখির ছোট দলে ওরা ঘুরে বেড়ায়। ওদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে প্রধানত পাহাড়ি ফল। তবে টিকটিকি, ইঁদুর, সাপ এবং পাখির ছানাও খায়। ফেব্র“য়ারি-এপ্রিল প্রজনন মৌসুম। ওরা এক থেকে তিনটি ডিম দেয়। মেয়ে পাখি একাই একটানা চার সপ্তাহ ডিমে তা দিয়ে ছানা ফোটায়। ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ওদের বিচরণ রয়েছে। বিশ্বে ওরা ‘প্রায়-বিপদগ্রস্ত পাখি’র তালিকাভুক্ত।

লেখক : প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক এবং
দৈনিক কালের কণ্ঠের শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
biswajit.bapan@gmail.com

সূত্র : ১৫ নভেম্বর ২০১৩ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics