প্রকৃতি; রঙিন ডানার ঝালর প্রজাপতি
আ ন ম আমিনুর রহমান
ফুল ও পাখির মতো প্রজাপতিও প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টি। কল্পনায় যত রং ভাবা যায়, তার সবগুলো রঙেরই বোধ হয় প্রজাপতি হতে পারে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনোয়ারের আমন্ত্রণে গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রজাপতি মেলায় গিয়েছিলাম। সেখানে নানা প্রজাতির বাহারি প্রজাপতি দেখে মনটা ভরে গেল। এরপর একদল তরুণ প্রকৃতিচারীর সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশে পাখি ও প্রজাপতির খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। মাঝপথে দেখা হয়ে গেল কুদরত-ই-খুদা, অঞ্জন, সাবু ও ওয়াহিদুজ্জামানের মতো কয়েকজন প্রকৃতিপ্রেমী আলোকচিত্রীর সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দিনভর পাখি ও প্রজাপতির ছবি তুললাম। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যে ৫০০ প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্ত করা হয়েছে, তার ১০২টিরই দেখা মেলে জাবিতে। সেদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু প্রজাপতি দেখলেও একটির সৌন্দর্যেই বেশি মুগ্ধ হয়েছি।
অনিন্দ্যসুন্দর এই প্রজাপতির নাম লেপার্ড লেসউইং (Leopard Lacewing)। অধ্যাপক শফিক ও অধ্যাপক মনোয়ারের ফিল্ড গাইড অনুযায়ী, এর বাংলা নাম ‘ঝালর’ বাহারি এই প্রজাপতির ডানার প্রান্তে চমৎকার ঝালরের মতো থাকায় এই নাম। Nymphalidae পরিবারভুক্ত এই প্রজাপতির বৈজ্ঞানিক নাম Cethosia cyane। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর এই প্রজাপতি এ দেশে মূলত পাহাড়ি এলাকায়, যেমন: সিলেট, চট্টগ্রাম ও রাঙামাটিতে দেখা যায়। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সহজেই চোখে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নানা প্রজাতির প্রজাপতির দেখা মিললেও আজ পর্যন্ত এদের দেখা পাইনি।
ঝালর মধ্যম থেকে বড় আকৃতির প্রজাপতি। প্রসারিত অবস্থায় স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে ডানা ৮৫-৯৫ মিলিমিটার হয়। হঠাৎ দেখলে পুরুষ ঝালরকে বাঘ বা ডোরাকাটা বাঘ প্রজাপতির বলে ভুল হতে পারে। তবে ডানার নিচের সাদাকালো ঝালরটিই এদের পরিচয় বলে দেয়। পুরুষ ঝালরের ডানার ওপরের দিকের রং উজ্জ্বল হলদে-বাদামি। তার ওপর রয়েছে বিভিন্ন আকারের অসংখ্য কালো কালো দাগ বা ফোঁটা। ওপরের ডানার দুই কিনারা কালো ও এরপর রয়েছে সাদা দাগ। ওপর ও নিচের ডানার কিনারা ঢেউ খেলানো ও তাতে বিধাতা অতি সুন্দর সাদাকালো ঝালর তৈরি করে দিয়েছেন। স্ত্রী ঝালরের ডানার রং পুরুষের তুলনায় বেশ হালকা, বিশেষ করে নিচের ডানার রং। তা ছাড়া কালো দাগ বা ফোঁটাগুলোও পুরুষের তুলনায় বড় ও একটির সঙ্গে অন্যটি যেন মিশে গেছে। ডানাসহ দেহের নিচের দিকের রং অনুজ্জ্বল বাদামি।
এরা ভেজা পাতাঝরা, চিরসবুজ ও আধা-চিরসবুজ বনাঞ্চল বেশি পছন্দ করে। দ্রুত উড়তে সক্ষম হলেও বিরক্ত না হলে বা ভয় না পেলে ধীরগতিতেই ওড়ে। দিনভর ঝোপঝাড়ের আশপাশে ঘুরে ঘুরে ও ফুলে ফুলে মধু পান করে বেড়ায়।
স্ত্রী ঝালর উপযুক্ত গাছের নতুন গজানো নরম ও কচিপাতার নিচের দিকে প্রতি পাতায় একসঙ্গে চার থেকে ২০টি করে ডিম পাড়ে। লেমন হলুদ রঙের ডিমগুলো লম্বাটে ও চওড়া এবং তাতে লম্বালম্বিভাবে খাঁজকাটা থাকে। ডিম ফুটে শুককীট বের হতে কমপক্ষে ছয় দিন এবং শুককীট থেকে মুককীট হতে ১৫ থেকে ১৮ দিন সময় লাগে।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের কোনো কোনো রাজ্য এবং মিয়ানমারে এদের দেখা মেলে। এ দেশে ফুল ও পাখি সম্পর্কে আমরা যতটা খোঁজখবর রাখি, সে তুলনায় প্রকৃতির সৌন্দর্য প্রজাপতি সম্পর্কে ততটা রাখি না। কিন্তু প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-03-03/