প্রকৃতি বিষয়ক আলোকচিত্রঃ ভালো নাকি মন্দ ??
অন্যের সাথে প্রাকৃতিক বিশ্বের সৌন্দর্য এবং আশ্চর্য দেখার আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবার একটা চমৎকার উপায় হলো প্রকৃতি বিষয়ক ফটোগ্রাফি বা আলোকচিত্র। আমাদের মধ্যে যাদের সময় বা সামর্থ্য নেই প্রকৃতি আর প্রকৃতির মাঝে ছড়িয়ে থাকা সৌন্দর্যকে উপভোগ করার, তাঁদের কাছে প্রকৃতির এক টুকরো ছবি এক-একটা ভ্রমণ কাহিনী। এই শিল্পের একটি সুস্পষ্ট গুণ এর মাধ্যমে বিশেষ ল্যান্ডস্কেপ এবং প্রজাতি রক্ষার বিষয়ে আমাদের মধ্যে সচেতনতা এবং সহানুভূতি তৈরি হয়, আমরা ঠিক করি প্রকৃতি আর প্রজাতি রক্ষায় আমাদের করনীয় কী- বা কী নয়।কিন্তু আমাদের এই অত্যধিক ভালোবাসার একটি খারাপ ফলাফলও হতে পারে,আমাদের অতিরিক্ত উৎসাহ- উদ্দীপনায় পদদলিত হতে পারে প্রকৃতি, ভীত হতে পারে প্রাণীকুল। ফটোগ্রাফির ইতিহাস যতটা পুরনো,প্রকৃতি ও প্রাণীজগতের সংরক্ষণ হাতিয়ার হিসেবে ফোটোগ্রাফির ব্যবহার ততটাই পুরনো। ১৮৬০ এর দশকে অ্যামেরিকার পশ্চিম বিষয়ক সমীক্ষা কার্যক্রমে হেডেন এক্সপিডিশনের সঙ্গে সমীক্ষা ও ভ্রমণে উইলিয়াম হেনরি জ্যাকসন তাঁর ভ্রমন সময়কার যে আলোকচিত্র ধারণ করেছিলেন, পরবর্তীতে ১৮৭২ সালে সেই আলোকচিত্রগুলোই অ্যামেরিকার কংগ্রেসকে ইয়েলোস্টোনকে ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে ঘোষণায় বাধ্য করেছিল এবং এটি পরে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক বিশেষ জায়গাগুলোকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণায় বিশ্বব্যাপী আন্দোলনে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এক শতক পরে আনসেল এডামস সেই মশালকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন, লক্ষ চোখের সামনে তুলে ধরেছেন অ্যামেরিকার বুনো পশ্চিমের অপার সৌন্দর্য। আর সাম্প্রতিক সময়ে বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্রীরা বড় এবং ছোট বন্য প্রাণীর আলোকচিত্র ধারণ করছেন তাঁদের কাছাকাছি আসছেন, তাঁদের ভালবাসছেন, আর আমরা বন্যপ্রাণীদের কাছাকাছি না পৌঁছেই নিরাপদে উপভোগ করতে পারছি তাঁদের মহনীয় আর মায়াময় সৌন্দর্য। কিন্তু অনেকে মনে করে থাকেন বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্র ধারণের একটি অন্ধকার দিকও রয়েছে। ১৯৯৭ এর ডাবল টেইক ম্যাগাজিনের শরৎ সংখ্যায়, বন্যপ্রাণীরক্ষা কর্মী এবং লেখক বিল ম্যাককিবেন তাঁর লেখায় তুলে ধরেন এক উল্টো মত, তাঁর মতে, পৃথিবী জুড়ে এখন যথেষ্ট সংখ্যক বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলকচিত্রী রয়েছেন এবং এখন বিষয়টা প্রাণীদের জন্য একটি অব্যাহত আক্রমণে পরিনত হয়েছে। প্রাণী বিষয়ক চিত্রের সুবিশাল সরবরাহ ইতিমধ্যে উপলব্ধ এবং তা প্রাণী রক্ষায় অবদান না রেখে বরং এখন তাঁদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফি বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠা ধারণারও তীব্র নিন্দা করেন তিনি। প্রশ্ন ছুড়ে তিনি বলেন- যখন আমরা হুপিং ক্রেনস হাজার হাজার ফটো দেখছি তখন আমরা কি করে বলবো পাখিটি হারিয়ে যাচ্ছে, যখন আপনি পাখিটিকে দশবার ছবিতে আর একবার বাস্তবে দেখছেন, আপনি কি অনুভব করতে পারেন তাঁর অস্তিত্ব আসলে কোথায়?? ম্যাককিবেনের এহেন কথায় অনেক ফটোগ্রাফারেরই লোম দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু, ব্রিটিশ আলোকচিত্রী নিয়েল বেনভি মনে করেন সমস্যাটি ফটোগ্রাফির নয় ফটোগ্রাফারের, তাঁদের ক্যামেরা প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করতে ব্যর্থ হয়। এটি হওয়া উচিৎ প্রাণী- পরিবেশকে কোন প্রকার উত্যক্ত না করে এবং তাঁদের বাসস্থানে কোন প্রকার ধ্বংসসাধন না করে।
কিন্তু সাম্প্রতিক দিনগুলোতে যখন ছুটি কাটাতে যাওয়া বা শখের বশে ঘুরে বেড়ানো কারো হাতে নুন্যতম ৫০০ ডলার মূল্যের একটি এসএলআর থাকছে, তখন এটি বোধহয় ভাবা বোকামিই হবে যে আমরা কোন প্রজাটিতে চিরতরে বিলীন করে দিচ্ছিনা।সাম্প্রতিক সময়ে অ্যামেরিকাতে কিছু কিছু ন্যাশনাল পার্কে কিছু ফটোগ্রাফি এলাকাকে দর্শক আর আলোকচিত্রীদের জন্য সীমিত করে দেয়া হয়েছে যাতে করে সেখানকার পায়েচলা পথগুলোর দুপাশে গজিয়ে ওঠা দেশজ প্রজাতির গাছগুলোকে পদদলিত হয়ে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যায়। অন্যদিকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে কানি উপজাতিরা অবাধে কেটে চলেছে গাছ এবং বাতি আর ভয় দেখানোর কৌশলে ধরছে স্প্লেন্ডার। আর ফটোগ্রাফাররা একটি ভালো ছবির আশায় নষ্ট করছেন এন্ডেমিক প্রাণীদের আবাসস্থল।
পৃথিবী জুড়ে পেশাদার- অপেশাদার আলকচিত্রীরা যদি এই মতে একহোন যে, একটি ভালো ছবির জন্যে একটি নির্মল প্রকৃতি গড়ে তুলবেন, একটি ভালো ছবিই তাঁদের প্রকৃতি আর পৃথিবীর অস্তিত্ব রক্ষায় হাতিয়ার, তবে প্রকৃতি বিষয়ক আলোকচিত্র পরিবেশের জন্য চাবুক নয় বরং রক্ষাকবচ হতেই পারে।
এনভাইরনমেন্টমুভ ডট কম.