প্রকৃতির বুদ্ধিমান ছাত্ররা….!!!
মাহবুব রেজওয়ান
প্রাচুর্য আর প্রাণের আধার এই পৃথিবী। হাজার বছর ধরে প্রাণের উদ্ভব আর বিকাশে পৃথিবী ক্রমাগত সমৃদ্ধ হচ্ছে, হচ্ছে বৈচিত্র্যময়। পৃথিবী আর পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজতে আজ মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্পেসশিপ, জলের অতলে চলছে অসীম অনুসন্ধান। মানুষ, প্রাণী হিসেবে এ যাবতকালের সবথেকে বুদ্ধিমান বলে প্রমাণিত তবে এ কথাও ঠিক, আমাদের বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষকও আমরাই। সে যাই হোক, মানুষের পর প্রকৃতির আর কোন সৃষ্টি বুদ্ধিমান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে তা নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা, গবেষণার ফলাফলও পাওয়া যাচ্ছে। চমকপ্রদ আর বিস্ময়ে ভরপুর সেই ফলাফল দেখে নেয়া যাক আমাদের এই আয়োজনে।
আবিসিনিয়ান বিড়াল :
প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তা যাচাই নিঃসন্দেহে এক কঠিন কাজ। কোন কোন ক্ষেত্রে তা মোটামুটি অসম্ভব। বিশেষ করে বিড়ালগোত্রীয় প্রাণীদের ক্ষেত্রে। যেহেতু, তারা মালবাহী প্রাণীদের মতো অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী নয়, সেহেতু এরা সামাজিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে খুব একটা থাকে না। অপরদিকে, কুকুর শ্রেণীর প্রাণীদের ক্ষেত্রে মনিবকে মান্য করার একটা সহজাত প্রবনতা দেখা যায়। সুতরাং, স্বভাবতই বিড়াল ও কুকুরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে বৈপরীত্য প্রতীয়মান। কিন্তু, আবিসিনিয়ান (Abyssinian) বিড়াল, যেটিকে বিড়ালগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাচীনতম বলে গণ্য করা হয়, বিড়াল পালনকারী অভিজাত সমাজে সেটিকে সবথেকে বুদ্ধিমান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
এটা ঠিক যে এদের প্রশিক্ষণ দেয়া যায় না। তবে এই প্রজাতির বিড়ালের মধ্যে নতুন কিছু শেখার প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। এরা ‘ ছুড়ে মারা এবং তুলে আনা” খেলায় খুবই পটু আর নির্ভরযোগ্য। যা কিনা অন্য বিড়াল শ্রেণীতে অনুপস্থিত। এদের বুদ্ধিমত্তা পরিমাপের জন্য তেমন কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা না হলেও অনেকেই বলেন, এরা প্রাণশক্তিতে ভরপুর এবং দারুন কৌতূহলী। তালা ঘুরিয়ে দরজা খোলার মতো ছোট ছোট ধাঁধাঁর সমাধান করতেও তারা সক্ষম।
Border Collie : সীমান্তরক্ষী লোমশ স্কটিশ কুকুর
বর্ডার কলি বা সীমান্তরক্ষী লোমশ স্কটিশ কুকুর প্রজাতির কুকুর হলো ” চেজার”, যাকে পৃথিবীর সবথেকে বুদ্ধিমান কুকুর হিসেবে গণ্য করা হয়। এই প্রজাতির কুকুর অস্বাভাবিক রকমের বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করে। স্ট্যানলি কোরেন তার ” কুকুরের বুদ্ধিমত্তা” বা “দি ইন্টেলিজেন্স অব ডগস” বইতে এই প্রজাতিটিকে সবচেয়ে বুদ্ধিমান কুকুর বলে অভিহিত করেছেন। তিনি কিছু মানসিক দক্ষতার পরীক্ষার মাধ্যমে (যেমন, বিভিন্ন বস্তুর নাম মনে রাখা, নতুন নতুন কৌশল রপ্ত করা ইত্যাদি) দেখান যে এই প্রজাতির কুকুরগুলোই সবথেকে নির্ভরযোগ্যভাবে কাজগুলো সম্পন্ন করে।
“চেজার” যাকে পৃথিবীর সবথেকে বুদ্ধিমান কুকুর বলা হচ্ছে, সে এক হাজারেরও বেশি শব্দ শিখেছে। যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বস্তুর নাম এবং ক্রিয়াপদ। এছাড়াও বিভিন্ন বিশেষণ ও সর্বনামবাচক শব্দও এর অন্তর্গত। তাছাড়া, সে বিভিন্ন বিষয়ে প্রাথমিক ধারনা নিতে পারে। এমনকি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়ার ক্ষমতাও তার রয়েছে।
গৃহপালিত প্রানিঃ শুকর
শুকর একটি পরিচিত গৃহপালিত প্রাণী, যা দুধ, মাংস, এমনকি পশমের চাহিদাও পূরণ করে থাকে। শুকর এমন একটি প্রাণী যারা পৃথিবীর অন্য যেকোনো প্রাণীর চেয়ে দ্রুত কিছু শিখতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রাণীটি আয়নায় নিজের প্রতিফলন চিনতে পারার পরীক্ষায় পাশ করতে না পারলেও আয়নার সাহায্যে নিজ দৃষ্টির অগোচরের খাদ্য খুঁজে বের করতে পারে। যা সম্ভবত প্রমান করে তারা নিজেরদের থেকে নিজেদের খাদ্যের ব্যাপারে বেশি চিন্তিত।
যেকোনো নতুন জিনিস দ্রুত শিখে নেয়ার ব্যাপারে শুকরের কোন জুড়ি নেই। এই সম্পর্কে “নিউইয়র্ক টাইম্স” এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ” শুকররা সকল প্রাণীর মধ্যে সবথেকে দ্রুত যেকোনো দৈনন্দিন কাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তারা সার্কাসের বিভিন্ন কলাকৌশল যেমন রিং এর মধ্য দিয়ে লাফ দেয়া, সোজা হয়ে দাঁড়ান, দর্শকদের সামনে মাথা নত করা,বিভিন্ন নির্দেশে অর্থবহ শব্দের মাধ্যমে সাড়া দেয়া, খাঁচা খোলা ও বন্ধ করা ইত্যাদি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করে থাকে। এমনকি তারা জয়স্টিকের সাহায্যে বিভিন্ন ভিডিওগেমসের খেলাও খেলতে পারে।”
পাখিঃ কাক !!
কাক সাধারনত কর্কশ এবং কুৎসিত পাখি হিসেবে পরিচিত হলেও প্রাণী সমাজে তাদের যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। কাক যে শুধু তাদের নিজেদের নানারকম সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাই নয়। কোন কিছু দ্রুত শিখতে পারার ক্ষমতাও এদের প্রবল। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, কাক যে সব মানুষকে নিজেদের জন্য বিপদজ্জনক বলে মনে করে তাদের চেহারা পর্যন্ত এরা মনে রাখতে পারে। শুধু তাই নয়, গবেষণায় শেষ পর্যন্ত এটাও লক্ষ্য করা গেছে, কোন একজন ব্যক্তি যদি একটি কাকের ক্ষতি করে থাকে, তবে ঐ এলাকার সব কাকই ঐ ব্যক্তিকে নিজেদের শত্রু বলে মনে করে। এমনকি সেই ব্যক্তিটি যদি ঐ এলাকার সব কাকের মুখোমুখি নাও হয়ে থাকে, তারপরও তার সাথে এমনটাই ঘটে। ব্যাপারটি সত্যিই আশ্চর্যজনক!!
মাছঃ গোল্ড ফিস
মাছদের প্রশিক্ষণ দেয়া অত্যন্ত জটিল আর কঠিন কাজ। অনেকটা অসম্ভবের কাছাকাছি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক যেভাবে কাজ করে, মাছের মস্তিষ্ক তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে কাজ করে। এই কারণে কুকুর, বিড়াল, টিয়া পাখি অথবা অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীকে যেভাবে প্রশিক্ষন দেয়া যায়, মাছের ক্ষেত্রে সেই পদ্ধতি কাজ করে না। তবে বেশ কয়েক বছর প্রশিক্ষন দেয়ার পর একজন ব্রিটিশ ভদ্রলোক গোল্ডফিস নিয়ে কাজ করে কিছুটা সফলতা লাভ করেছেন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি একটি গোল্ডফিসকে দিয়ে কিছু সাধারন নির্দেশ পালন করাতে সক্ষম হয়েছেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে মুখ দিয়ে একটি বলকে নির্দিষ্ট স্থানে নিক্ষেপ করা।
সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীঃ বোতল নাক ডলফিন
এ নিয়ে কোন বিস্ময় বা প্রশ্ন নেই যে পশুদের মধ্যে শিপ্পাঞ্জি এবং বনোবোর পরে বোতল নাকের ডলফিনদেরকেই সব থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে ধরা হয়। এই প্রজাতির ডলফিনদের নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। আর এইসব গবেষণার মধ্য দিয়ে তাদের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে বিস্ময়কর তথ্য উন্মোচিত হচ্ছে। তারা একে অপরকে বিভিন্ন ধরনের খেলা এবং কৌশল শেখানোর জন্য সুপরিচিত। যেমন লেজে ভর দিয়ে পানির উপরে হাঁটা, পানির ভিতরে বুদবুদ তৈরি করার কৌশল ইত্যাদি তারা একে অপরকে শিখাতে পারে। বোতল নাক ডলফিন নৌ-বাহিনীর মাধ্যমেও প্রশিক্ষণ লাভ করেছে। তাছাড়া এটাও প্রমানিত যে, সংখ্যা সম্বন্ধেও তাদের কিছু ধারনা রয়েছে। ডলফিনের নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করাটা বেশ দুরুহ একটি কাজ। এর কারণ, ডলফিন খুব ভালো অনুকরণ করতে পারে। তাদের অনুকরণ করার ক্ষমতা নিঃসন্দেহে অসাধারণ! কিন্তু, এটি কি শুধুই তাদের অনুকরণ করার ক্ষমতা? নাকি তাদের বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ? কে জানে!!
সরিসৃপঃ মনিটর লিজার্দ
মনিটর লিজার্দ বা বড় আকারের টিকটিকি সদৃশ সরীসৃপদের সমগ্র আফ্রিকা, ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ এশিয়া আর অস্ট্রেলিয়াতে বহুলভাবে দেখা মেলে। বিশালদেহী আর ভয়ংকর দেখতে এই সরীসৃপগুলো শুধু যে গায়ে গতরেই বিশাল তাই নয়। বরং, সরীসৃপ শ্রেণীর প্রাণীদের মধ্যে এরাই সবচেয়ে দ্রুত কোন কিছু শিখতে পারে। এরা প্রমাণ করেছে এরা বিভিন্ন গ্রুপে সন্নিবেশিত বিভিন্ন বস্তু গুচ্ছের মধ্যে কোনটি সর্বোচ্চো সংখ্যা বিশিষ্ট সেটি নির্ধারণ করতে পারে নিখুঁতভাবে, শুধু তাই নয়, সেই সংখ্যাটি কত তাও চিহ্নিত করতে পারে!!!!
প্রাইমেট বর্গঃ বনোবো
মানুষের পর শিপ্পাঞ্জিকে সবথেকে বুদ্ধিমান প্রাণী বলে মনে করা হয়। শিপ্পাঞ্জি অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী। তবে বুদ্ধিতে শিপ্পাঞ্জিকেও হার মানায় তাদেরই এক আত্মীয়, যারা বনোবো নামে নামে পরিচিত।
বর্তমানে “কাঞ্জি” (Kanzi) হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে জনপ্রিয় ও সুপরিচিত বনোবো। বর্তমানে তার বয়স ত্রিশ বছর। ভাষাগত দিক থেকে “কাঞ্জি” বনোবোর ইতিহাসে অসামান্য পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছে। কাঞ্জি ইতিমধ্যে পেক-ম্যান নামের একটি গেমস খেলায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে। এছাড়াও মার্সমেলো (marshmallow) নামক একধরনের খাদ্য, যা আগুনে ঝলসে খেতে খুবই সুস্বাদু ,সেটি আগুনে ঝলসে খেতে শিখেছে। গবেষকরা শিপ্পাঞ্জি এবং বনোবোর সাথে যোগাযোগের জন্য লেক্সিগ্রাম নামক একধরনের ভাষা চালু করেছেন। এই লেক্সিগ্রাম ব্যবহারে কাঞ্জি সব থেকে বেশি সফলতা দেখিয়েছে। তাছাড়া, আমেরিকাতে যেসব সাংকেতিক ভাষা প্রচলিত রয়েছে ,সেটিও ধীরে ধীরে রপ্ত করে ফেলছে। বর্তমানে কাঞ্জি স্বরযন্ত্র ব্যাবহার করার পদ্ধতি শিখছে। সোজা বাংলায় বলতে গেলে মানুষের ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করছে ( যদিও কাজটি মোটামুটি অসম্ভবের কাছাকাছি। কারণ, মানুষ আর বনোবোর স্বরযন্ত্রের গঠনে অনেক পার্থক্য রয়েছে)।