নীল-কপালি লালগির্দি
আ ন ম আমিনুর রহমান
২০১০ সালের ২০ নভেম্বর। লালবুক টিয়ার বাসা ও প্রজননের ছবি তোলার জন্য ঢাকা চিড়িয়াখানায় ঘুরছি। বেলা তিনটায় উদ্যানতত্ত্ব কার্যালয়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বাঁ পাশের পেঁপেগাছে ছোট্ট একটা অপরিচিত পাখি বসতে দেখলাম। মাত্র দুটো ছবি তোলার সুযোগ দিয়ে ৩০-৪০ সেকেন্ডের মধ্যেই উড়াল দিল। আরেকবার আসে কি না, দেখার জন্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম; কিন্তু এল না। ঘণ্টা খানেক ঘোরাফেরার পর আবার এলাম। না, সে নেই।
বাসায় ফিরে যতগুলো ফিল্ড গাইড ও পাখিসংক্রান্ত বই আছে, নিয়ে বসলাম, কিন্তু সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারলাম না। এরপর যতবার চিড়িয়াখানা ও সংলগ্ন জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে গিয়েছি, ততবারই পাখিটি খুঁজেছি। এ দেশের আনাচকানাচে যখন যেখানে গিয়েছি, ওকে খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও পাইনি। বেশ কয়েকজন পাখি বিশেষজ্ঞকেও ছবি দেখিয়েছি। তবে কেউ ওর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি। শেষটায় আমাদের ক্লাব ন্যাচারাল হিস্ট্রি অ্যান্ড কনজারভেশন সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাবেক সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক অনুজ মনিরুল খানকে ছবি পাঠালাম। তিনি এটিকে অপ্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী-পাখি হিসেবে শনাক্ত করলেন। এর আগে ঢাকার গ্রামাঞ্চলে দেখার রেকর্ড থাকলেও সাম্প্রতিক কালে দেখা যায়নি বলেও জানালেন। অতএব, জানামতে এটিই স্ত্রী নীল-কপালি লালগির্দির তোলা প্রথম ছবি।
এতক্ষণ যার কথা বললাম, সে ভবঘুরে পাখি ‘নীল-লালগির্দি’ (Blue-fronted Redstart)। অনেকে ‘নীল-কপালি গির্দি’ নামেও ডাকে। এর কোনো স্থানীয় বা আঞ্চলিক নাম নেই। আমি ওর নাম দিয়েছি নীল-কপালি লালগির্দি। বাংলাদেশ এটি অনিয়মিত (Vagrant) পরিযায়ী পাখি হিসেবে বিবেচিত। পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Phoenicurus frontalis। নীল-লাল গির্দি চড়ুই আকারের পাখি। লম্বায় ১৫ সে.মি. ও ওজনে ১৭ গ্রাম। পুরুষটির কপাল উজ্জ্বল নীল। মাথা ও পিঠের পালক গাঢ় নীল। গলা, বুক এবং ডানাও গাঢ় নীল। ডানার পালক-ডাকনির কিনারা কালচে। দেহের নিচের অংশ কমলা-বাদামি। কোমা ও পেট কমলা-লাল। লেজের কিনারা কালচে। স্ত্রী-পুরুষের দেহের রঙে বেশ পার্থক্য। স্ত্রীর দেহের ওপরটা জলপাই-বাদামি, অন্যান্য প্রজাতির গির্দির তুলনায় বেশি গাঢ়। দেহের নিচের অংশ জলপাই-বাদামি থেকে কমলা-বাদামি। কোমর কমলা-লাল; পেট ও লেজের নিচে কমলার আভা। চোখের চারদিকে রয়েছে সাদা বলয়। ঠোঁট, পা, পায়ের পাতা ও নখ কালো। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখিগুলোর ডানার পালক-ডাকনির কিনারা সাদা বা হালকা কমলা।
পরিযায়ী এ পাখি শীতে চারণভূমি, ঝোপঝাড়, মাঠ ও খোলা বনে চরতে পছন্দ করে। পোকাখোর হলেও রসাল ফল এবং বীজেও অরুচি নেই। গাছের ডাল বা ঝোপঝাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পোকা ধরে। পোকা ধরার জন্য গাছ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নামে; অনেক সময় শূন্য থেকেও ধরে। মূলত একাকী বিচরণ করলেও প্রজননের পর ও পরিযায়নের সময় ছোট দলেও দেখা যায়। সাধরণত ‘টিক’ বা ‘প্রিট’ করে এক শব্দে ডাকে। তবে ভয় পেলে ‘ইটিট-ইটিট-ইটিট’ বা ‘টট-টট-টট’ স্বরে বিরামহীন ডাকতে থাকে। জুনের মাঝামাঝি এদেরকে সুমধুর স্বরে গান গাইতেও দেখা যায়।
মে থেকে আগস্ট এদের প্রজননকাল। জমির আইল, দুই পাথরের ফাঁক বা গাছের খোঁড়লে মস বা শেওলা দিয়ে ছোট্ট বাটি আকারের বাসা বানায়। বাসা বানাতে গাছের ছোট্ট শিকড়, চুল, পালক ইত্যাদি ব্যবহার করে। স্ত্রী গির্দি তিন বা চারটি হালকা গোলাপি-ধূসর বা হালকা হলদে রঙের ডিম পাড়ে, যার ওপর থাকে হালকা লালচে দাগ।
সুত্রঃ প্রথম আলো, ২২,০৩,২০১৩