দুর্লভ লাল ট্রগন

আ ন ম আমিনুর রহমান

2013-06-05-19-32-04-51af9234a7924-untitled-27
বিপন্ন লাল ট্রগন। পুরুষ ট্রগনের এই ছবি গত ২৬ মার্চ আদমপুর বিটের গহিন বন থেকে তোলা
ছবি: লেখক

ওকে প্রথম দেখেছিলাম লাউয়াছড়ায়, ২০১১ সালের এপ্রিলে। রঙিন পাখিটির চোখ ধাঁধানো রূপে এতটাই বিমোহিত ও সম্মোহিত হয়ে পড়েছিলাম যে ক্যামেরায় ক্লিক করতে ভুলে গিয়েছিলাম। সংবিৎ ফেরার পর আর ওর দেখা পাইনি। আফসোস, সেবার কোনো ছবি তুলতে পারিনি। এরপর দুটি বছর ওর খোঁজে কাপ্তাই, আদমপুর, লাউয়াছড়া, রেমা-কালেঙ্গা—কোথায় যাইনি? কিন্তু অত্যন্ত লাজুক ও নিভৃতচারী পাখিটির ছবি তোলা দূরে থাক, একনজর দেখাই পাইনি।
এ বছরের ২৭ এপ্রিল সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘Save the Frogs Day’ উপলক্ষে প্রাণী অধিকার রক্ষার সংগঠন প্রাধিকার আয়োজিত সেমিনারে সভাপতিত্ব করার আমন্ত্রণ এল। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পড়বেন বন্য প্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী তানিয়া খান। তাই মৌলভীবাজারে তাদের ওখানে গিয়েছিলাম আগে। ২৬ এপ্রিল ভোর ছয়টায় অটোরিকশায় আমরা কয়েকজন রওনা দিলাম সোজা কমলগঞ্জের আদমপুরের উদ্দেশে। বনে পৌঁছে ঘণ্টা তিনেক হাঁটার পর জঙ্গলের গহিনে চলে এলাম। একটা জায়গায় সবাই চুপচাপ অপেক্ষা করছি। আমি ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত। হূৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। টান টান উত্তেজনা। একপর্যায়ে প্রতীক্ষার সফল অবসান হলো। দেখা পাওয়া গেল তার।
এতক্ষণ যার কথা বললাম, সে এ দেশের এক অতি সুন্দর ও দুর্লভ পাখি লাল ট্রগন বা লাল-মাথা ট্রগন (Red-headed Trogon)। কেউ কেউ কুচকুচি, লাল-মাথা কুচকুচি বা কুচকুচিয়া নামেও ডাকে। মূলত সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের গহিন বনে দেখা মেলে। ট্রগনিডি পরিবারের একমাত্র সদস্য লাল ট্রগনের বৈজ্ঞানিক নাম Trogon erythrocephalus. বর্তমানে এ দেশে এদের বিপন্ন (Endangered) হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ট্রগন কোকিল আকারের পাখি। লম্বা ৩৫ সেমি। ওজন ৭৫ গ্রাম। দেহের মূল রং বাদামি। স্ত্রী ও পুরুষের রঙে বেশ পার্থক্য। পুরুষের পিঠ মরচে বাদামি, পেট ও তলপেট গোলাপি। মাথা, ঘাড় ও বুকের পালক গাঢ় লাল এবং বুকে একটি সাদা বলয় রয়েছে। ডানার পালক কালো-ধূসর বর্ণের সূক্ষ্ম দাগে ভরা। চৌকো লেজটি বেশ লম্বা, যা ক্রমান্বয়ে ছোট থেকে বড় পালকে গড়া। লেজের পালকের ওপরের দিক বাদামি ও নিচেরটা সাদা-কালো। অন্যদিকে, স্ত্রী পাখির মাথা, ঘাড় ও বুকের পালক দারুচিনি রঙা। ডানার পালকের সূক্ষ্ম দাগগুলো বাদমি-হলুদ। স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে চোখ ও অক্ষিগোলক ধূসর রঙের। পা বেগুনি। ঠোঁট দুই রঙা; ওপরেরটি বেগুনি-নীল ও নিচেরটি কালো। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির বুক, পেট ও তলপেট হলদে-সাদা।
এরা চওড়া পাতাওয়ালা বৃক্ষ আছে এমন ঘন চিরসবুজ বন ও মিশ্র বাঁশবনে থাকতে পছন্দ করে। একাকী বা জোড়ায় থাকে। পা বেশ দুর্বল হওয়ায় হাঁটাহাঁটি কম করে। গাছের ১৪-২০ ফুট উঁচু কোনো ডালে নীরবে বসে থাকে। ভালো উড়তে পারলেও তেমন একটা ওড়াউড়ি করতে দেখা যায় না। বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়, লার্ভা ও রসাল ফল পছন্দ। গাছের ডাল থেকে উড়ে উড়ে বা মাটিতে নেমে পোকামাকড় ধরে খায়। এরা অত্যন্ত শান্ত, লাজুক ও নিভৃতচারী পাখি। গাছের আড়াল থেকে নম্র-মধুর স্বরে ‘কিউ-কিউ’ বা ‘টিয়াউপ-টিয়াউপ’ করে ডাকে।
এপ্রিল থেকে জুলাই প্রজননকাল। সাধারণত ঘন বনে গাছের ৫-১৭ মিটার উচ্চতায় কোনো প্রাকৃতিক কোটর বা কাঠঠোকরার পরিত্যক্ত গর্তে বাসা বাঁধে। কখনো কখনো ছড়ার পাশের গাছেও বাসা বাঁধতে দেখা যায়। স্ত্রী ট্রগন তিন-চারটি হালকা হলুদ রঙের ডিম পাড়ে। অতি সুন্দর ও বিপন্ন ট্রগনকে রক্ষা করতে হলে দেশের গহিন বনগুলো রক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো (০৭/০৬/২০১৩)

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-06-06/news/358239

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics