দুরন্ত চিতাবাঘ!
আ ন ম আমিনুর রহমান
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি এগ্রিকালচারাল এডুকেশনের ব্যবহারিক পরীক্ষায় বহিঃপরীক্ষক হিসেবে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাডি সেন্টারে গিয়েছিলাম ২০০৯ সালের ৪ জুলাই। বন্ধু অধ্যাপক গৌতম দেবনাথের বাসায় দুপুরের খাবার খাওয়ার পর পরীক্ষাকেন্দ্রের দিকে যাচ্ছিলাম। এমন সময় হলুদ একটা কিছু উড়ে যেতে চোখে পড়ল। আর স্বভাবগতভাবেই ওর পিছু নিলাম। কিন্তু সে উড়ছে তো উড়ছেই, একটুও বসছে না। ওর পেছনে-পেছনে ছুটতে ছুটতে যখন ঘেমে উঠেছি, ঠিক তখনই একটি লাল-হলদে ফুলের ওপর গিয়ে সে বসল। তবে বেশি সময় দিল না। এর মধ্যেই প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিলাম। দ্বিতীয়বার ওর বসার অপেক্ষা করলাম না। কারণ, পরীক্ষা নেওয়ার তাড়া আছে। পরীক্ষাকেন্দ্রের দিকে এগোলাম। এরপর ওকে বহুবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দেখেছি।
এতক্ষণ যার কথা বললাম, সে হলো গাঢ় হলুদ ও কালো রঙের দুরন্ত এক প্রজাপতি। এই প্রজাপতির ডানার রং ও কারুকাজ চিতাবাঘের দেহের মতো বলে এদের চিতাবাঘ, হলুদ চিতা বা চিতা বলে। ইংরেজি নাম Common Leopard বা Leopard Butterfly। Nymphalidae পরিবারভুক্ত এই প্রজাপতির বৈজ্ঞানিক নাম Phalanta phalantha phalantha। হলুদ চিতা মাঝারি আকারের প্রজাপতি। স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে প্রসারিত অবস্থায় ডানা ৫০ থেকে ৬০ মিলিমিটার হয়। দেহ ও ডানার ওপরের দিকের রং উজ্জ্বল হলুদ-বাদামি। তার ওপর রয়েছে সারিবদ্ধ কালো দাগ, যা মাথা বা পিঠে নেই। ডানার কিনারার দাগগুলো দেখতে অনেকটা শাড়ির পাড়ের মতো। স্ত্রী প্রজাপতির ক্ষেত্রে এ দাগগুলো সামান্য বড় হয়। ডানাসহ দেহের নিচের দিকের রং অনুজ্জ্বল বাদামি। তাতে নীল বা সবুজ আভা। শুকনো মৌসুমে প্রজাপতিগুলোয় উজ্জ্বল বেগুনি আভা দেখা যায়।
এরা এ দেশের সর্বত্র বাস করলেও সহজে চোখে পড়ে না। মূলত শুকনো ঝোপঝাড় ও পাতাঝরা বনের বাসিন্দা হলেও ভেজা পাতাঝরা এবং চিরসবুজ ও আধা চিরসবুজ বনের প্রান্ত, এমনকি সমুদ্রপৃষ্ঠের দুই হাজার মিটার উঁচুতেও দেখা যায়। সারা বছর দেখা গেলেও বর্ষার আগে ও শুরুতেই এদের আনাগোনা বেশি। ছায়া পছন্দ করে না বলে সব সময় রোদেলা ঝোপঝাড়ে উড়ে বেড়াতে দেখা যায়। তবে এরা কিন্তু চিতার মতো দ্রুতগতিসম্পন্ন নয়; বরং বেশ ধীরগতিতে ওড়ে। বেশি উঁচু গাছ পছন্দ করে না। ফুলের মধু পান করার সময় ডানা আধখোলা অবস্থায় রাখে। অনেক সময় এদের দল বেঁধে স্যাঁতসেঁতে মাটিতেও বসে থাকতে দেখা যায়। এরা ভেজা মাটির রসও পান করে।
স্ত্রী প্রজাপতি সারা বছর ডিম পাড়তে সক্ষম হলেও গ্রীষ্মের শেষেই বেশি ডিম পাড়ে, যখন ফ্ল্যাকোরশিয়া (Flacourtia) গাছে নতুন লালচে কচি পাতা গজায়। এরা কুঁড়ি ও কচি পাতার নিচের দিকে একটি করে ডিম পাড়ে। গম্বুজ আকারের এই ডিমের রং উজ্জ্বল হলুদ। এরা বেশ দ্রুত, মাত্র ২১ দিনেই জীবনচক্র সম্পন্ন করে।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, জাপান ও হংকংয়ে এদের দেখা যায়। সুন্দর এ প্রজাপতিগুলো আমাদের পরিবেশেরই অংশ। তাই এদের সম্পর্কে জানতে হবে এবং এদের রক্ষা করতে হবে।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো (১৩/০৬/২০১৩)