দি গ্রেট মাইগ্রেশনঃ ভয়ংকর বিপদসংকুল গন্তব্যে এক মহাদলের মহাঅভিযাত্রা
মাইন রানা
পূর্ব আফ্রিকার প্রাণী ওয়াইল্ডবিস্টের মাইগ্রেশন বা পরিযায়ন পৃথিবীর বন্যপ্রাণীর ইতিহাসে মধ্যে এক বিস্ময়কর ঘটনা। এই মাইগ্রেশন এতই চমকপ্রদ যে, তাকে বলা হয়ে থাকে ‘দি গ্রেট মাইগ্রেশন’ যা দেখার জন্য প্রতি বছর বিশ্বের হাজার হাজার পর্যটক তাঞ্জানিয়া ও কেনিয়ায় ভিড় জমায়। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে খাদ্যের খোঁজে ওয়াইল্ডবিস্ট প্রতিবছর তাঞ্জানিয়ার ‘সেরেঙ্গেতি ন্যাশনাল পার্ক’ থেকে কেনিয়ার ‘মাসাই মারা গেইম রিজার্ভ’ গিয়ে আবার তাঞ্জানিয়া ফিরে আসে যে পথের দূরত্ব ১৮০০ মাইলেরও বেশী। তাঁদের এই দীর্ঘ্য মাইগ্রেশন বা পরিযায়নকারী দলে থাকে প্রায় ১৫ লক্ষ ওয়াইল্ডবিস্ট। সাথে যোগ দেয় আরো প্রায় ৪ লক্ষ জেব্রা ও লক্ষাদিক এন্টিলোপ গেজেল। এদের পরিযায়নের দলটি এত বিশাল বড় হয় যে কয়েকশ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে দলের সদস্যদের বিস্তৃতি থাকে। বিস্তৃর্ণ সমভূমিতে পড়ে থাকে তাঁদের পদচিহ্ন। আকাশ ঢেকে যায় তাঁদের পদ ধূলির মেঘে।
তাঁদের এই মহাযাত্রা অত্যন্ত বিপদসংকুল ও দুর্গম। যাত্রা পথে তাঁদের দিতে হয় চরম মূল্য। মারা গিয়ে তাঁদের দল থেকে চিরতরে হারিয়ে যায় প্রায় ৩ -৪ লক্ষ সদস্য। যাদের অধিকাংশ চলে যায় ক্ষুদার্ত হায়েনা, সিংহ, চিতা, নেকড়ে, শিয়াল, বুনো কুত্তার শিকার হয়ে তাঁদের পেটে। কিছু সদস্য জীবন দেয় কঠিন পথ পাড়ি দিতে গিয়ে আহত ও অসুস্থ হয়ে। যাত্রা পথে পড়ে থাকে শত শত মৃত প্রাণী যা খাবারের জন্য দলের মাথার উপরেই সারাক্ষণ উড়তে থাকে শকুনের দল। তাঁদের দলকে সবচেয়ে চরম মূল্য দিতে হয় ‘গ্রুমেতি নদী’ ও ‘মারা নদী’ পাড়ি দিতে গিয়ে। পূর্ব আফ্রিকার এই দুটি নদী ভর্তি থাকে শত শত ক্ষুদার্ত কুমিরে। ওয়াইল্ডবিস্ট এর দল যেদিক দিয়ে নদী পাড় হবে সেই সময়টাতে তারাও সেখানে দলে দলে এসে জড়ো হয়। ওয়াইল্ডবিস্টরা নদী পাড় হতে শুরু করার পর থেকেই চলতে থাকে কুমিরের হত্যা ও শিকারের এক ভয়ংকর মহাতাণ্ডব। মারা যায় ওয়াইল্ডবিস্টের শত শত সদস্য, নদী দুটি পূর্ণ হয়ে যায় লাশের পাহাড়ে। তবে এই মৃত্যুর সাথে সাথে সুখবর হল এদের প্রজনন হার খুবই উচ্চ এবং প্রতি বছর এদের দলে জন্ম নেয় ৪–৫ লক্ষ নতুন সদস্য এবং ওয়াইল্ডবিস্টের জনসংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে।
ওয়াইল্ডবিস্টের পরিচয়ঃ
ওয়াইল্ডবিস্ট একধরণের তৃণভোজী স্তন্যপায়ী প্রাণী। এরা এন্টিলোপ জাতীয় গরুর চেয়ে একটু ছোট এবং হরিনের চেয়ে বড়। জোড়া খুড়ওয়ালা ও শিং বিশিষ্ট তৃণভোজী প্রাণীটি দেখতে অদ্ভুত রকমের। না গরু না ছাগল না ঘোড়া না গাধা বরং এই সবগুলির মিশ্রন বললেও ভুল বলা হবে না। ইংরেজি ওয়াইল্ডবিস্ট (Wildebeest) একটি ডাচ শব্দ যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় বুনো জন্তু বা বুনো গরু। এই প্রাণীটির গোত্র (Family) হল বভিডিই (Bovidae)। মহিস, গেজেল, এন্টিলোপ, ভেড়া, বুনো ছাগল, গৃহপালিত গরু সবাই এই গোত্রের অন্তর্গত। এদের দুটি প্রজাতি বর্তমানে পাওয়া যায়। একটি হল ব্লু বা নীল ওয়াইল্ডবিস্ট যার ৫ টি উপপ্রজাতি আছে। আরেকটি হল ব্লাক বা কালো ওয়াইল্ডবিস্ট যার কোন উপপ্রজাতি নেই। এর আরেকটি পরিচিত নাম গুনু। এরা সারাক্ষণ এক ধরনের শব্দ তৈরি করে যা হাজার হাজার সদস্যের শব্দ মিলে গুঞ্জনের সৃষ্টি করে। আর এই গুন গুন শব্দের কারণেই তাঁদের গুনু নামে ঢাকা হয়। আফ্রিকার ছোট ছোট স্থানীয় আধিবাসীরা গুনু নামেই এদের ডকে এবং গুন গুন শব্দ শুনে বহুদূর থেকেই তাঁদের আসার খবর পেয়ে যায়।
মাইগ্রেশন বা পূর্নাঙ্গ পরিযায়ন এর বর্ননাঃ
১) ডিসেম্বর থেকে মার্চঃ এই সময় ওয়াইল্ডবিস্ট এর দল তাঁদের মাতৃভূমি তাঞ্জানিয়ার সেরিগাতিসমভূমিতে অবস্থান করে। তাঁদের সাথে এখানে চষে বেড়ায় জেব্রা সহ অন্যান্য প্রাণীরা। এই সময় এখানে প্রচুর ঘাস জন্মে তাই এটাই তাঁদের বাচ্চা জন্ম দেবার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। লক্ষ লক্ষ ওয়াইল্ডবিস্টের বাছুর এসময় জন্ম নেয়। মাত্র তিন সপ্তাহে প্রায় ৫ লক্ষ নতুন প্রজন্মের জন্ম নেয়া। মায়েদের আসে পাশে হাজার হাজার নতুন বাছুরের দৌড়ানোর আসাধারণ সুন্দর দৃশ্য জগতে বিরল। কিন্তু এ সুন্দর দৃশ্যের মাঝে উকি দেয় ভয়ঙ্কর বিপদ। অল্পবয়স্ক এসব বাছুর শিকার করতে সেখানে জড়ো হতে থাকে প্রচুর শিকারি প্রাণী। বাচ্চাদের শিকার করা তুলনামূলকভাবে সহজ হবার কারণে শিকারী প্রানীরা হত্যা করতে থাকে একের পর এক বাছুর।
২) এপ্রিল থেকে জুনঃ বৃষ্টি কমে যাওয়ায় সেরিগাতি সমভূমিতে ঘাস কমে যেতে থাকে তাই ওয়াইল্ডবিস্টের দল উত্তর-পশ্চিমের দিকে ধীরে ধীরে কিছুটা আগ্রসর হতে থাকে। মে মাসের শেষ দিকে বৃষ্টি একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় তখন উত্তর-পশ্চিম দিকের এই অগ্রসর দীর্ঘ্য যাত্রায় রুপান্তরিত হয়। সাথে যুক্ত হয় জেব্রা, গেজেল সহ আরো কিছু তৃণভোজী। জুন মাসে তারা সেরিগাতি সমভূমির একদম পশ্চিমকোনে অবস্থান করে। এসময় তাঁদের পুরুষ-স্ত্রীর মিলন ও শুক্রানোর বিনিময় ঘটে।
৩) জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরঃ প্রচন্ড রোদ ও খরায় সমস্ত সেরিগাতি সমভূমি শুষ্ক হয়ে হলুদ বর্ণ ধারণ করে। আশে পাশে কোথাও সবুজের লেশমাত্র নেই। সম্পুর্ণ দলটি এই সময় প্রথমে ‘গ্রুমেতি নদী’ ও পড়ে ‘মারা নদীর’ তীরে এসে জমা হয় যে নদী গুলি পূর্ণ থাকে শত শত ক্ষুদার্ত ভয়ঙ্কর শক্তিশালী কুমিরে। কুমিরের হাতে থেকে রক্ষা পেতে সবাই একসাথে জমা হবার পর একটি স্থান দিয়েই তারা নদী পাড় হতে শুরু করে। এই দুই নদীই হল তাঁদের যাত্রাপথের সবচেয়ে ভয়ংকর অধ্যায়। কুমিরের হাতে মারা পড়ে শত শত ওয়াইল্ডবিস্ট ও জেব্রা। সেপ্টেম্বরের শেষ ও অক্টোবরের প্রথম দিকে তারা মাসাই মারা সমভূমিত যা ‘মাসাই মারা গেইম রিজার্ভ’ নামে পরিচিত সেখানে অবস্থান করে।
৪) অক্টোবন থেকে নভেম্বরঃ অক্টোবরে দক্ষিণে বৃষ্টি শুরু হলে পুরো দল আবার দক্ষিণের পথে যাত্রা শুরু করে এবং খুব দ্রুত নভেম্বরের মাঝামাঝিতে তারা আবার সেরিগাতি সমভূমিতে ফিরে আসে। এর পর ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত তারা এখানেই অবস্থান করে এবং সন্তান জন্ম দেয়। এর পর মার্চে তাঁদের আবার উত্তর পশ্চিমের যাত্রা শুরু হয়। এভাবেই চলতে থাকে জীবন আর সংগ্রাম।
ভয়ংকর দুটি নদীঃ
ওয়াইল্ডবিস্টের দীর্ঘ্য পরিযায়নের পুরো পথটিই নানা বিপদ ও প্রতিকুলতায় ভরা। প্রতি পদে পদে তাঁদের মৃত্যুর হাতছানি। হায়েনা, সিংহ, চিতা, নেকড়ে, শিয়াল, বুনো কুত্তা সহ আরো অনেক শিকারী প্রাণী তাঁদের নিত্য দিনের সঙ্গী। তবে তাঁদের সবচেয়ে বেশী ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয় দুটি নদী পাড় হতে গিয়ে। এই দুটি নদীকে বলা হয়ে সাক্ষাত মৃত্যুর উপত্যকা। ‘গ্রুমেতি নদী’ ও ‘মারা নদী’ হল সেই দুটি নদী। এখানে শত শত কুমির অপেক্ষায় থাকে কখন ওয়াইল্ডবিস্টের দল এই জায়গা দিয়ে পাড় হবে। এসব কুমিররা শিকারেও অত্যন্ত দক্ষ। বিশাল বিশাল শক্তিশালী একেকটা ওয়াইল্ডবিস্টকে তারা মুহুর্তেই হত্যা করে ফেলে। ওয়াইল্ডবিস্টের দল চলে যাবার পর নদীগুলিতে পড়ে থাকে শত শত মৃতদেহ। এই নদীগুলো পাড় হতে থাকার দৃশ্যও এক বিরল দৃশ্য। লক্ষ লক্ষ ওয়াইল্ডবিস্ট নদীর তীরে জরো হতে হতে হটাৎ একটি মাত্র স্থান দিয়ে লাইন ধরে পাড় হতে থাকে নদী। পাড় হতে থাকা ওয়াইল্ডবিস্টের উপর হামলে পড়ে দলে দলে ক্ষুদার্ত কুমির। তুমুল লড়াই ও হত্যার মধ্যেও ওয়াইল্ডবিস্ট এর দল এগিয়ে চলে সামনের পথে, জীবনের পথে। ছবিঃ ইন্টারনেট