
তাঞ্জানিয়ার পাথুরে জাদুঘর !!
মাহবুব রেজওয়ান
ছোটবেলায় রূপকথার গল্পে রাজপুত্রের পাথর হয়ে যাওয়ার গল্প আমরা সবাই কম বেশি জানি। সেই রাজপুত্র, যে কিনা দৈত্যের হাত থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে ঘোড়া ছুটিয়েছিল দৈত্যের আস্তানার দিকে। কিন্তু, দৈত্যের চোখে চোখ পড়ার সাথে সাথেই পাথর হয়ে যায় রাজপুত্র। রূপকথার গল্পে পাথরের রাজপুত্র হয়তো আবারও মানুষ হয়ে দৈত্যের সাথে লড়াই করেছিল। তবে রিক ব্র্যান্ডটের (Rick Brandt) ক্যামেরায় যা ধরা পড়েছে, তা রূপকথাকেও হার মানাতে বাধ্য!! কারণ আলোকচিত্রি রিক ব্র্যান্ডটের ক্যামেরায় পাথরের ফ্লামিঙ্গ,ঈগল,বাদুড়সহ যে আরও অনেক কিছুই ধরা পড়েছে!!
ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে আমাদের যেতে হবে সুদূর আফ্রিকার তাঞ্জানিয়ায়। যেখানে রয়েছে ‘লেক নেটরন’ নামের একটি লবণাক্ত লেক। অনেকের ধারনা, এই লেকের পানির ছোঁয়ায় সব পশুপাখি পাথর হয়ে যায়। লেক তো নয়! যেন রূপকথার দৈত্য!! এখন রূপকথার জগত থেকে বরং বাস্তবতার মাটিতে পা রাখা যাক।
তাঞ্জানিয়ার পাহাড়বেষ্টিত দুর্গম এলাকার একটি লেক হচ্ছে এই ‘লেকনেটরন ‘।
এই লেকটির পানি এতটাই লবণাক্ত যে কিছু কিছু সংবেদনশীল প্রাণীর উপর এর চরম প্রভাব দেখা যায়। ছোট আকারের কিছু প্রাণীর ত্বক ও চোখের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে এই লেকের লবণাক্ত পানি। লেকটির পানি পরীক্ষা করে দেখা গেছে লেকটির পানি অত্যন্ত ক্ষারীয়। এর pH এর পরিমাণ ৯.৫ থেকে ১০.৫ পর্যন্ত হয়ে থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে এর থেকেও বেশি হয়। এতো বেশি লবনাক্ততার উৎস মূলত সোডিয়াম কার্বনেট এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ। যা লেকের পানিতে আসে লেকটিকে বেষ্টন করে রাখা পাহাড়গুলো থেকে। বছরের পর বছর ধরে এভাবে সোডিয়াম কার্বনেট জমা হওয়ার ফলে লেকটি হয়ে উঠেছে সোডিয়াম কার্বনেট ও অন্যান্য খনিজের এক মহা ভাণ্ডার। সোডিয়াম কার্বনেট এমন একটি খনিজ যা কিনা প্রাচীন মিসরীয় মমি তৈরির অন্যতম একটি উপাদান হিসেবে ব্যাবহার করা হত। আর এই কারণেই যখন এই লেক বা তার আশেপাশের এলাকায় কোন পাখি বা অন্যান্য প্রাণী মারা যায়, তখন তা এই খনিজের প্রভাবে অনেকটা অপরিবর্তিত অবস্থায় সংরক্ষিত থাকে। তাছাড়া, নেটরন লেকটি বড় কোন নদী বা সাগরের সাথে মিলিত না হওয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে এর লবনাক্ততা অপরিবর্তিত রয়েছে।
নেটরন লেকের লবনাক্ততা সত্ত্বেও লেকটি বাস্তুতন্ত্রের চমৎকার একটি উদাহরণ। প্রধানত ফ্লামিঙ্গ পাখিদেরই আধিক্য দেখা যায় লেকটিতে। তাছাড়াও অনেক প্রজাতির পাখি ও বাদুড় রয়েছে লেকটিকে বেষ্টন করে রাখা পাহাড়গুলোতে। পাখিগুলো যখন তাদের জীবন পথের যাত্রা শেষ করে ফেলে, তখন অনেক সময় পাহাড় থেকে গড়িয়ে লেকের পানিতে গিয়ে জমা হয়। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ার সময় এদের মৃতদেহের গায়ে অনেক কাদামাটি জমা হয়। সেই সাথে লেকের পানি ও লবনাক্ততাও মিশ্রিত হয়। লেকের পাড়ে দিনের পর দিন থেকে শুকিয়ে যাবার পর এদের দেখলে মনে হয় রূপকথার জগত থেকে আগত পাথরের কোন মূর্তি। অথবা মনে হয় কোন শিল্পী পরম মমতায় এদের খোঁদাই করেছে পাথর কেটে।
আলোকচিত্রি রিক ব্র্যান্ডট এই রকমই বিভিন্ন মৃত পাখি বিশেষ ভঙ্গিমায় রেখে বেশ কিছু ছবি তুলেছেন। যা সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তার লেখা “Across The Ravaged Land”(২০১৩) বইটিতে তিনি এই বিষয়ে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। তার তোলা অনেক ছবিও তিনি প্রকাশ করেছেন বইটিতে। তবে লেকনেটরন তাকে কোন বাঁধা ছাড়াই কাজ করতে দিয়েছে, তা ভাবলে ভুল হবে। তার কোডাক (Kodak) ফিল্মের অনেক কালি নষ্ট হয়ে গেছে এই জলের সংস্পর্শে এসে।
তবে সম্প্রতি নেটরন লেকের পার্শ্ববর্তী নদী ওআসো গিরো (Ewaso Ngiro) তে হাইড্রো ইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের কাজ শুরু করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলেনেটরন লেক তার স্বাভাবিক বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলবে। ধ্বংস হবে পাখিদের আবাস। রূপকথার গল্পগুলো যেমন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাঝ থেকে, তেমনি বাস্তবের রূপকথার কারখানাটিও হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে।
এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক
সূত্রঃ ইন্টারনেট
ছবিঃ Lake Natron Gives Up Its Dead