“ট্যুরিজম অ্যান্ড ওয়াটার প্রটেক্টিং আওয়ার কমন ফিউচার”-বাংলাদেশের সম্ভাবনা কতটুকু!
ফারজানা হালিম নির্জন
ধনধান্য পুষ্পে ভরা,আমাদের এই বসুন্ধরা/তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা…হুম,সেই সেরা দেশটি যে আমাদের বাংলাদেশ,তা নিয়ে দ্বিতীয় কোনো কথা থাকতে পারেনা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ,বাংলাদেশ। এখানে ঋতু পরিবর্তনের গান শুনিয়ে যায় জানা-অজানা পাখির দল,সবুজের আধিপত্য আর নীলের প্রাচুর্যতা এখানে চোখে পড়বার মতো। কি নেই এখানে!সবকিছুই আছে,শুধু নেই এমন কিছু জিনিস,যার জন্যে আমরা আজও পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলো থেকে তুলনামূলকভাবে অনেকখানি পিছিয়ে আছি। শুধুমাত্র অবহেলা আর অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনাই আমাদের অনেকখানি পিছিয়ে থাকার কারণ। এবার তবে নমুনা হিসেবে দেখা যাক আমাদের অপার সম্ভাবনাময়ী পর্যটন খাতটি,যা কিনা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও এখনো রয়ে গেছে সরকারি বিশেষ নজরদারীর একেবারে সর্বশেষ অবস্থানে!
“বিশ্ব পর্যটন দিবস” ছিলো গত ২৭শে সেপ্টেম্বর।এবারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ‘ট্যুরিজম অ্যান্ড ওয়াটার প্রোটেক্টিং আওয়ার কমন ফিউচার’।
বলার অপেক্ষা রাখে না, নদীমাতৃক দেশ হিসেবে আমাদের বাংলাদেশের জন্য এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়টি যেন একেবারেই খাপ খাওয়ানো। কিন্তু বাস্তবতা বলছে একেবারেই ভিন্ন কথা। যে শিল্পটি গেলো বছর,২০১২ তে পুরো বিশ্বে ১০০ কোটির উপরে পর্যটক ধারণ করেছে,বিশ্ববাণিজ্যে যে শিল্পটি এককভাবে ৬ শতাংশ ধারণ করে, সে শিল্পটি বাংলাদেশে কোন পর্যায়ে আছে! এবার তবে তার কিছুটা জেনে নেয়া যাক। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কম্পিটিটিভনেস,পর্যটনশিল্পে বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীতামূলক অবস্থান তুলে ধরছে তাদের প্রকাশিত রিপোর্টে। সে অনুযায়ী ২০১৩ সালের রিপোর্ট টিতে বাংলাদেশ বিষয়ক তথ্যের যোগান দিয়েছে সিপিডি’র তিনজন গবেষক। তার আগে বলা প্রয়োজন,এর আগে প্রকাশিত ২০১১ ও ২০০৯ সালের রিপোর্ট অনু্যায়ী মোট ১৩৩ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ১২৯! আর আশার বাণী এতোটুকুই,২০১৩এর রিপোর্ট অনু্যায়ী মোট ১৪০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ উঠে এসেছে ১২৩ তম অবস্থানে। তার মধ্যে আলাদাভাবে এশিয়া প্যাসিফিক অংশে মোট ২৫ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে শেষে। অর্থাৎ ২৫ তম!আর ১২৩ তম অবস্থানে আসার পর,আমাদের পেছনে যে দেশগুলো রয়েছে,তা হচ্ছে আফ্রিকার সমস্যাসংকুল দেশগুলো;যেমন আইভরি কোস্ট,লেসোথো,সিয়েরালিওন ইত্যাদি। তাহলে আমরা কেন এতো পিছিয়ে! আমাদের অবস্থানটি কি আরো এগিয়ে আসা উচিৎ ছিলোনা! আমাদের পার্শ্ববর্তী দুটি দেশ,পাকিস্তান ও মিয়ানমারে ২০১২ সালে ১ মিলিয়নের উপর পর্যটক ভ্রমন করে গেছেন,সে তুলনায় আমাদের প্রাপ্তি অনেক অনেক নিচে। কিন্তু এর পেছনের কারণ গুলো আসলে কী! কেন আমাদের এতো সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা এগতে পারছিনা! সরকারের নীতিনির্ধারকেরা ফি বছর অনেক অনেক আশার বাণী শোনানো সত্ত্বেও বাস্তবতা সাক্ষী দিচ্ছে সম্পূর্ণ উলটো চিত্রের। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে পোশাক শিল্পের পরই অর্থনৈতিকভাবে দেশকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাওয়ার সবচাইতে স্বর্ণালী সম্ভাবনার খাতটি হলো পর্যটন শিল্প। অথচ এই খাতটিই আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত এবং এখনো কেবল বিলাসিতার ফ্রেমেই একে আঁটকে রেখেছি আমরা।
বিশ্বের পর্যটকরা কেন আমাদের দেশে বড় পরিসরে আসছেননা, তার কিছু কারণ ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে পুলিশের সেবায় আস্থার অভাব এবং উচ্চহারে সড়ক-দূর্ঘটনাকে তুলে ধরা হয়েছে উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে। এছাড়াও রয়েছে ট্যুরিস্টদের ভিসা প্রদানে অনাকাংক্ষিত জটিলতা,পোর্ট ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার অভাব,পর্যটন এলাকায় ঘনবসতি,চাঁদাবাজি ও অকারণ হয়রানির শিকার হওয়া,সর্বত্র এ.টি.এম কার্ড ব্যবহারের সুযোগ না থাকা থেকে শুরু করে আরো অসংখ্য কারণ। সর্বোপরি,আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ও নিমিষেই পর্যটক আকর্ষণকারী জায়গাগুলোতে আমরা নিজেরাই পরিবেশ নষ্ট করছি বিভিন্ন উপায়ে। সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও কি এইসব ব্যাপার নিয়ে আরও একবার ভাবা উচিত নয়?
তবে কিছু আশার বাণীতো নিশ্চয়ই আছে।নিতান্তই কচ্ছপের গতিতে হলেও উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছু কিছু পদক্ষেপ সরকার ইতিমধ্যে নিয়েছে। তবে বিশ্বের দরবারে,কিংবা আমাদের এগিয়ে যাবার প্রত্যয়ের কাছে তা নিতান্তই অপর্যাপ্ত। এরই মধ্যে বর্তমান সরকার ‘বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড’ গঠনের মাধ্যমে তার সূচনা করেছে। এখন প্রয়োজন এই বোর্ডটিকে গতিশীল করার ব্যাপারে বাসতবসম্মত উদ্যোগ নেয়া। এর মধ্যেই আরো একটি প্রশংসনীয় কাজ হচ্ছে,প্রায় ৫০ টি দেশের জন্য ‘অন অ্যারাইভেল’ ভিসা চালু করা।যার ফলে ইউরোপ,আমেরিকা,অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের বিভিন্ন ধনী রাষ্ট্রের নাগরিকরা আমাদের যেকোনো বন্দরে পৌঁছানোর পর কোনো ঝামেলা ছাড়াই ভিসা নিতে পারবেন। তাছাড়া ‘ট্যুর অ্পারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ এর মতে এবারে,অর্থাৎ ২০১৩ সালে তারা এতো বেশি পরিমাণ পর্যটকের আনাগোনা দেখতে পাচ্ছেন,যা কিনা গত ২০ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে!
আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা স্বপ্ন দেখতে জানি। আমরা সবাই সংকল্পবদ্ধ হয়ে একত্রে কাজ করলে আময়াদের দেশকে এগিয়ে নেয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে এমন কিছু খুঁজে পাওয়া যাবেনা। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে এমন বহু প্রমাণ আমরা পৃথিবীর মানচিত্রে এঁকে দিয়েছি।বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার,সবচাইতে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন,পাহাড়ি সবুজে ঘেরা পার্বত্য চট্টগ্রাম,সিলেটের চা-বাগান থেকে শুরু করে আরো হাজার হাজার রত্ন যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে,সেই দেশ কেন সমস্ত পৃথিবীর কাছে পর্যটনের তীর্থভূমি হিসেবে গণ্য হবেনা! এ যে আমাদের জন্য কত বড় গর্ব,তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি,গ্রাম-বাংলার সবুজে ঘেরা মাটির সাথে মিশে যাওয়া মানুষদের অতি সাধারণ জীবন-যাপন,আদিবাসী গোষ্টীদের রকমারি রঙ্গিন উৎসব,সর্বোপরি বাঙ্গালী আতিথেয়তা পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বিশাল জায়গা দখল করে আছে। পর্যটকদের আকর্ষন করার জন্য একসাথে এতো এতো হীরের খনি বোধ হয় বিশ্বের আর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবেনা!আর তাই,এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ের দিকে আরো জোরালো হয়ে নজর দিয়ে আমাদের সবার উচিত,বাংলাদেশের প্রাণ;আমাদের নদীগুলোকে সর্বপ্রকার আশংকা ও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসা! এ নিয়ে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে।ইতিমধ্যে অনেক ছোট-বড় সংগঠন নদী বাঁচাতে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। একটা কথা আবারো স্মরণ করে নেবার পালা;পর্যটন শিল্প যত বেশি উন্নত হবে,আমাদের বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ততবেশি সমৃদ্ধ হবে!এমন দিন খুব বেশি দূরে নয়,যেদিন পুরো বিশ্ব বাংলাদেশকে একনামে চিনবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আর পর্্যটক আকর্ষনকারী দেশ হিসেবে। তবে তা বাস্তবায়নের জন্য দরকার সকলের সচেতনতা,পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা,সঠিক প্রচারণা এবং সর্বোপরি প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।
সূত্রঃ ,UNWTO, Tour Operators Association of Bangladesh
photo courtesy-Ashraful Alam