জলের তলে নীলের খেলা
ফারজানা হালিম নির্জন
ডুবুরীদের একটা ভাগ্যই বটে ! যত গভীরে যায়,রূপকথার এক একটি গল্প যেন রূপের পসরা সাজিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরে। এ তো আর সহজ কথা নয়! রহস্যের খামে বন্দী গোটা পৃথিবীটার একটা চিঠি বোধ হয় সমুদ্রের পানিতে ছুড়ে ফেলা হয়েছে কোনোভাবে। গভীর থেকে গভীরে গেলেই সেই চিঠির এক একটি অক্ষর যেন আবিষ্কৃত হয়,আর জন্ম দেয় অন্য আরেকটি অক্ষরকে জানার তেষ্টা। এভাবেইতো রহস্যের উন্মোচন হচ্ছে প্রতিনিয়ত! তেমনি রহস্যজনক এক সামুদ্রিক কীটের সন্ধান মিলেছে অনেক কাল আগে,যার নাম Chaeteopterus variopedatus। উপস্থিতি টের পেলেও এখন পর্যন্ত নিঁখুত কোনো সন্ধান মেলেনি অন্য আরেকটি রহস্যের। তাঁর এই ছোট্ট দেহ থেকে বিক্ষিপ্ত অদ্ভুত সুন্দর নীল আলোর দ্যুতি পুরো সমুদ্রকে আবিষ্ট করে রেখেছে এক মায়াময় আবেশে। কিন্তু কেমন করে ?এই রহস্যময়ী দ্যুতির উৎস কোথায় ? বিজ্ঞানীরা অনেক দূর এগিয়ে গেলেও কিছু রহস্য এখনো রয়ে গেছে বিজ্ঞানীর ভাবনায় আর গবেষণায়।
Chaeteopterus variopedatus, পার্চমেন্ট টিউব ওয়ার্ম নামেও এর পরিচিতি রয়েছে। পাতলা কাগজের মত টিউব আকারের দেহ এই ক্ষুদ্র কীটের। বায়োলুমিনিসেন্ট,অর্থাৎ জীবের শরীর থেকে দ্যুতি বের করার প্রক্রিয়া,ঠিক এই ধরণের এক প্রকার মিউকাস আছে তার দেহে। যার ফলে সে নীল আলোয় আলোকিত হয়ে থাকে সবসময়।
এই পার্চমেন্ট টিউব ওয়ার্ম গুলো বাস করে পুরো বিশ্ব জুড়েই,সমুদ্রের অগভীরে আর সমুদ্র তলদেশের বালুর বিছানায়। অন্যান্য টিউব ওয়ার্ম থেকে এদেরকে সহজেই আলাদা করা যায় একমাত্র দীপ্তিময় আভার কারণে। অন্য টিউব ওয়ার্মগুলো এই আভা তৈরী করতে পারেনা। কিছু অণুজীব শরীর থেকে এক ধরণের সবুজ আলো নিঃসরণ করে,কিন্তু তা একেবারেই সেই নীল দীপ্তিময় আভার মত নয় ! আলোক বর্ণালীতে সবুজ আলো অন্যান্য আলো থেকে দ্রুত পরিবহণ করতে পারে,তাই অগভীর সমুদ্রে ঘোলাটে পরিবেশ সৃষ্টিতে এই সবুজ আলো নিঃসরণকারি কীটগুলোর তুলনা নেই। এরাতো সাধারণ বৈশিষ্ট্যই ধারণ করছে। কিন্তু সেই নীল দীপ্তিময় কীটগুলো ?
“Live Science’s Our Amazing Planet”- এই গবেষণার সাথে যুক্ত, দ্যা স্ক্রিপস ইন্সটিটিউট অব অশেনোগ্রাফির একজন জীব বিজ্ঞানী, দিমিত্রি দিহেইন বলেন-‘গভীর জলের থেকে সমুদ্রের অগভীর পরিবেশটি তুলণামূলকভাবে বেশি জটিল এবং সবুজ আলোতেই অণুজীবগুলো সবচেয়ে ভালভাবে দেখতে পায়।’ তিনি আরও বলেন, কেউ যদি বাস্তুসংস্থানের উদ্দেশ্যে সহযোগীতাস্বরূপ আলো উৎপাদন করতে চায়,তবে অবশ্যয়ই মাথায় রাখা উচিত যাতে অণুজীবেরা তা ভালভাবে দেখতে পায়। প্রায় দশ বছর আগে বিজ্ঞানীরা অসহযোগী সেই নীল দীপ্তিময় আলো নিঃসরণের কীট সম্বন্ধে অবহিত হয়েছেন,কিন্তু এর পেছনের কারণ কিংবা বৈশিষ্টগুলো সম্পর্কে নয় ! সাম্প্রতিক,জীব বিজ্ঞানি দিহেইন তাঁর কয়েকজন সঙ্গীর সাহায্যে নতুন দুটি গবেষণার জন্ম দিয়েছেন,যা কিনা এই রহস্যের ভাঁজ খুলতে কিছুটা হলেও সহায়ক ভূমিকা রেখেছে!
প্রথমত তাঁরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, Chaeteopterus variopedatus ধরণের কীটদের মত যেসব অণুজীব অপ্রয়োজনীয় কারণেই আলো নিঃসরণ করে,তাদের অক্সিজেনের একেবারেই কোনো প্রয়োজন হয়না ! অথচ আলো উৎপাদনের পেছনের ক্রিয়াকৌশল বলছে যে-অক্সিজেনের সাথে দুটি ক্যামিকেল বিক্রিয়া করার ফলে নতুন একটি যৌগ তৈরি হয়,যা থেকে পরবর্তীতে আলো উৎপন্ন হয়! বিগত গবেষণাগুলোও তাই সাক্ষ্য দিচ্ছে, অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে কীটের আলো ছড়ানোর প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ! সুতরাং এ ধরণের কীটেরা দীপ্তিময় আভা তৈরীর জন্য গতানুগতিক পথ থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে নতুন কোনো অভিনব পথ বেছে নিয়েছে। কী সেই পথ !
রাইবোফ্ল্যাভিন,যা ভিটামিন-বি২ নামেও বহুল প্রচারিত। দ্বিতীয়ত বিজ্ঞানীরা পরীক্ষার মাধ্যমে আশংকা করছেন,আলো তৈরীর জন্য রাইবোফ্ল্যাভিনের একটা ভূমিকা থাকতে পারে। কিন্তু কোন ধরণের ভূমিকা,তা এখনো অনিশ্চিয়তার কুয়াশায় ঢাকা। তবে তাঁরা এটুকু সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত,কীটেরা নিজেরাই রাইবোফ্ল্যাভিন প্রোটিন উৎপন্ন করতে পারে না ! টিউবের মধ্যে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়ার সিমবায়োসিস কিংবা আহারকৃত খাদ্য থেকে এই প্রোটিনটি তারা সংগ্রহ করে নেয়।
নীলাভ আলো ছড়াচ্ছে,ছড়াক! কিন্তু কেন! নীল রঙ্গটা নাহয় দূরেই থাক,অন্ততপক্ষে প্রথম প্রশ্ন আসে আলোটাই কেন ছড়াচ্ছে ! এর কারণ দিহেইনের গবেষনা দল এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছেনা। তবে তাঁরা এখনো গবেষণা করছেন। আশংকা করছেন,হয়তো শিকারকে আকৃষ্ট করার জন্য হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানে ‘আশংকা’র উপর কি ভরসা করা যায় ? এখানেও সেই রহস্যটা রয়েই গেলো।
জীববিজ্ঞানী দিহেইন বলেন,গোটা পৃথিবীতে প্রানীজগতে মোট প্রায় ২০-৩০ প্রজাতির বায়োলুমিনিসেন্ট প্রাণি রয়েছে। সবে মাত্র ৩ টি প্রজাতি নিয়ে তাঁরা বিশদ আকারে গবেষণা করছেন। এবং তা এখনো চলছে !
একদিন হয়তো রহস্যের সেই পুরো চিঠিটা পড়া হয়ে যাবে! আবার অন্যদিকে লেখা হবে নতুন আরেক চিঠি। রহস্যের কি আর শেষ থাকে কখনো !