জলবায়ু রাজনীতির অমিয় গরল
কামরুল ইসলাম চৌধুরী
ইংরেজ কবি জন কীটসের বিখ্যাত পংক্তি ‘ট্রুথ ইজ বিউটি, বিউটি ইজ ট্রুথ’ আর বর্তমান বিশ্বের সবচে বড় ইনকনভিনিয়েন্ট ট্রুথ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। এর চেয়ে নির্জলা সত্যি আর নেই।
বিশ্ব জলবায়ু বদলে যাচ্ছে। বদল হচ্ছে কার্বন দূষণ সমীকরণ। ১৯৯২ সালে তৈরি হয় জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সনদ। তখন সবচেয়ে বড় কার্বন দূষণকারী দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র। পেছন পেছন ছিল জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপসহ শিল্পোন্নত দেশগুলো। কার্বননির্ভর শিল্প বিপ্লবের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা আশংকাজনকহারে বেড়েই চলেছে। হচ্ছে উষ্ণায়ন, বাড়ছে সাগরের উচ্চতা, গলছে বরফ, বদল হচ্ছে জলবায়ুর গতি-প্রকৃতি। একই সঙ্গে বাড়ছে আবহাওয়ার খেয়ালিপনা। ঘনঘন হানা দিচ্ছে সুপার সাইক্লোন স্যান্ডি, সিডর, আইরিন, নার্গিস, বিজলি, রশ্মি ইত্যাদি। বাড়ছে বন্যা, খরাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো হচ্ছে চরম ক্ষতিগ্রস্ত।
তাই বিরানব্বই সালে প্রণীত জলবায়ু সনদে উন্নত শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোকে এজন্য ঐতিহাসিকভাবে দায়ী করা হয়। সে দায় থেকে উন্নত দেশগুলোকে ১৯৯৭ সালে তৈরি কিওটো চুক্তিতে ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০১২ সালের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ ভাগ কার্বন দূষণ কমাতে বাধ্য করা হয়। বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু ঝুঁকি কমাতে আর্থিক ও প্রযুক্তি সহায়তা দিতে বলা হয় উন্নত দেশগুলোকে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত অনেক দেশ কিওটো চুক্তি অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণ কমায়নি। ২০১৩ সালে এসে দেখা গেল বরং কোনো কোনো দেশ কার্বন দূষণ উল্টো বাড়িয়েই চলেছে। সঙ্গে যোগ দিয়েছে সেই জলবায়ু বিনাশী তালিকায় চীন, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশ। ফলে বদলে গেছে বিশ্ব জলবায়ুর মানচিত্র। বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জন্য মড়ার উপর খাড়ার ঘা ত্রিশংকু অবস্থা। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার হার যেখানে দেড় থেকে দুই ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখার কথা, তাও রাখা যাচ্ছে না। কার্বন দূষণ মাত্রা ৪০০ পিপিএম মাত্রা ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে, যা থাকার কথা ৩৫০ পিপিএমের নিচে। কার্বননির্ভর ভোগবাদী উন্নয়নই এর মূল কারণ। জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে উন্নত দেশের স্বার্থ। ফলে পাল্টে যাচ্ছে জলবায়ু রাজনীতির চালচিত্র। টালমাটাল হচ্ছে জলবায়ু অর্থর্নীতির গতি-প্রকৃতি। কার্বননির্ভর অর্থনীতির বাণিজ্যিক স্বার্থের বেড়াজালে মার খাচ্ছে হতদরিদ্র দেশগুলো। এসব দেশের জলবায়ু ঝুঁকি, বিষণ্নতা প্রতিদিন বাড়ছে। বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থীর মিছিল। স্বল্পোন্নত ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি, প্রাণবৈচিত্র্য, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, জীবন-জীবিকা হচ্ছে বিপন্ন।
তাই জাতিসংঘ জলবায়ু সনদের অধীনে শুরু হয়েছে নয়া দরকষাকষি। ২০১৫ সালের মধ্যে প্যারিস চুক্তি তৈরির দৌড়-ঝাঁপ চলছে। তার প্রাথমিক আলোচনা হবে নভেম্বরে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ নগরীতে। তার আগে সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সদর দপ্তর নিউইয়র্কে হবে আলোচনা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজ দেশের ঐতিহাসিক দায় কতটা পালন করতে রাজি তার ওপর নির্ভর করছে বিশ্ব জলবায়ু কূটনীতির ভাগ্য।
গেল সপ্তাহে শিকাগোতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট নোবেলজয়ী আল গোর জলবায়ু সংকট সমাধানে কার্বন কর বসানোর প্রস্তাব তুলেছেন। গোরের কথা হলো, এতে কার্বন দূষণের রাশ টানা যাবে। কর থেকে যে আয় হবে তা দিয়ে জলবায়ু মোকাবিলায় উন্নয়নশীল বিপন্ন দেশগুলোকে সহায়তা দেয়া যাবে। প্রশমন ও খাপ খাওয়ানোর কাজ জোর কদমে শুরু করা যাবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি হলেই কেবল দেড় থেকে দুই ডিগ্রির ভেতর রাখা যাবে। এজন্য প্রয়োজন হবে আশুভিত্তিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ব্যাপক বিনিয়োগ। বিকল্প জ্বালানির উত্স সন্ধান ও ব্যবহার বৃদ্ধি। বিশ্বের দেশে দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র বন্ধ করে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। এজন্য বিশ্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এখনই কঠোর-কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সব দেশকে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। নইলে দুনিয়াজোড়া তাপমাত্রা চরমভাবে বেড়ে যাবে। সাগরের বুক স্ফীত হবে। মরুময়তা দেখা দেবে। অধিক বরফ গলবে। পানি নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, মহামারী প্রভৃতি দেখা দেবে আরো ঘনঘন। মানুষের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা থাকবে না। জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়াবে কোটি কোটি। দারিদ্র্য বাড়বে দেশে দেশে, অর্থনীতি হবে লণ্ডভণ্ড। সেই ভয়াবহ বিপর্যয় রুখতে চাই জরুরিভিত্তিতে বিশ্ব সমঝোতা। প্রয়োজন কিওটো প্রটোকলের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্যারিস প্রটোকল সুসমন্বিতভাবে প্রণয়ন। প্যারিস প্রটোকল তৈরির সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে বিশ্ব বিপর্যয় অনিবার্য। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের আগামী দিনের ভাগ্য, স্বল্পোন্নত ৪৯ দেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা এবং গোটা বিশ্বের সবুজ উন্নয়ন।
লেখক : জাতিসংঘ জলবায়ু সনদের অধীনে চলমান নেগোশিয়েশনে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অন্যতম শীর্ষ দরকষাকষিকারী এবং অভিযোজন কমিটির সদস্য।
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক (১৬/০৮/২০১৩)