চিটাগাং থেকে চুকটকা

সায়েম ইউ. চৌধুরী
মায়ানমারের উপকূলে বৃহত্তম কাদাচরের নাম ‘মারতাবান’ গত শীতে আমাকে মারতাবান যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিল ‘চামচঠুঁটো-বাটান টাস্কফোর্স’ সারাদিন ‘চামচঠুঁটো-বাটান’ সন্ধান করে এক সময় আমরা কাদাচরে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। টাস্কফোর্স-নেতা ‘ক্রিস্টফ জক্লার’ সেখানে ছিলেন। গ্রীষ্মে চামচঠুঁটো-বাটানের প্রজনন-ভূমি ‘চুকট্কা’ যাওয়ার জন্য আমাকে তিনি আমন্ত্রণ জানালেন। রাশিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলের একেবারে পুবে অখ্যাত এক উপদ্বীপের নাম চুকট্কা। বিশ্বের মহা-বিপন্ন পাখি চামচঠুঁটো-বাটানের প্রজনন-ভূমি হিসেবে পরিচিত হওয়ার আগে খুব কম লোকই এর নাম জানতেন।282598_10150975961689178_489401608_n
এশিয়া মহাদেশের শেষ প্রান্তে লুকিয়ে থাকা সেই উপদ্বীপে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশে ফিরে এসে জরুরি কাগজপত্র সংগ্রহ করে আমি রাশিয়ার দূতাবাসে ভিসার আবেদন করলাম। সীমান্তবর্তী স্থান বলে চুকট্কা যেতে রাশিয়ার কর্তৃপক্ষের বিশেষ-অনুমতি লাগে। দুই সপ্তাহ ধরে নানা ধরনের কাগজ-পত্র নিয়ে আমাকে প্রতিদিন দূতাবাসে হাজিরা দিতে হলো। কাগজের পাহাড় গগনচুম্বী হলে দূতাবাস এক সময় আমার ভিসা মঞ্জুর করল।179129_10151023318369178_598863258_n
রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর উদ্দেশ্যে আমি ঢাকা ছাড়লাম। মস্কোতে এক দিন থেকে চুকট্কার উদ্দেশ্যে আমি আবার বিমানে উঠলাম। আমার গন্তব্য-স্থানের নাম ‘আলাদিয়া’ মস্কো আর আলাদিয়া রাশিয়ার একেবারে দুই প্রান্তে রয়েছে বলে এখন আমার সামনে ১১ ঘণ্টার বিমান ভ্রমণ।
557017_10151040885394178_831374203_n
চামচঠুঁটো-বাটান- চুকটকার প্রজনন অঞ্চলে।
ছবিঃ লেখক
চুকট্কায় আমাদের কাজ হলো চামচঠুঁটো-বাটানের বাসা থেকে ডিম চুরি করা। ডিম চুরি হয়ে গেলে চামচঠুঁটো-বাটান পাখিরা আবার ডিম দিয়ে ছানা লালন করে থাকে। আর বিশেষজ্ঞরা চুরি করা ডিম ইনকিউবেটরে দেন; তারপর ইনকিউবেটর থেকে ছানা নিয়ে লালন-পালন করার পর প্রকৃতিতে অবমুক্ত করা হয়। এভাবে কৃত্রিম উপায়ে ছানার সংখ্যা বৃদ্ধি করে চামচঠুঁটো-বাটানের বিলুপ্তি রোধের চেষ্টা চলছে। পাঁচ দেশ থেকে এবার আমরা ১৫জন মানুষ চুকট্কা এসেছি; মোট ২০টি ডিম চুরি করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আমি ছাড়া এ দলে আছেন যুক্তরাজ্যের ছয়জন, রাশিয়ার চারজন, জার্মানির তিনজন এবং নিউজিল্যান্ডের একজন ডিম-চোর।
আলাদিয়া থেকে হেলিকপ্টারে তিন ঘণ্টা উড়ে যেতে হলো আমাদের। তারপর সেনা-বাহিনীর আর্মার্ড- ভেহিক্যালে চড়ে গেলাম এক প্রান্তিক গ্রামে, নাম ‘মেইনাপিলগেনো’ এখান থেকে আমাদের যেতে হবে বরফ-গলা পানির খানা-খন্দকে ভরা জনহীন প্রান্তরে। সেখানে আমাদের প্রথম কাজ হলো চামচঠুঁটো-বাটানের প্রজনন এলাকাগুলো খুঁজে বের করা। পাখিগুলোর জীবনযাত্রায় বিঘ্ন না ঘটিয়ে কাজটা করা সহজ ছিল না। দিক-চিহ্নহীন প্রান্তরে আমাদের প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ কিলোমিটার হাঁটতে হতো।487195_10150975945814178_1614444546_n
বাংলাদেশ এবং মায়ানমার ছেড়ে পুরুষ চামচঠুঁটো-বাটানগুলো চুকট্কা এসে প্রজনন-এলাকা ঠিক করতে শুরু করে জুন মাসে। জুনের প্রথম দুই সপ্তাহেই আমরা ১৫টি প্রজনন-এলাকা শনাক্ত করতে পেরেছিলাম। সবগুলো প্রজনন-এলাকাতেই পাখি বাসা বাঁধেনি। কয়েকটি প্রজনন-এলাকায় পুরুষ চামচঠুঁটো-বাটান বৃথাই অপেক্ষা করতে থাকল; জোড়ার স্ত্রীগুলো এল না। হয়তো বাংলাদেশ, মায়ানমার অথবা যাত্রা-পথে কোরিয়া, চীন কিংবা অন্য কোখাও তারা মারা পড়েছে। আমরা চামচঠুঁটো-বাটানের প্রথম বাসাটি খুঁজে পেয়েছিলাম ১৩ জুন তারিখে। আরও অনেক বাসা পেয়েছি তার পর পরই। ২৩ জুন তারিখের মধ্যেই আমরা সে সব বাসা থেকে ২০টি ডিম চুরি করতে সক্ষম হলাম।417677_10151011926499178_2038572184_n
চৌর্যবৃত্তি শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমাদের চুকট্কা ছেড়ে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। আমাদের স্বদেশে ফেরার আগেই চুরি করা ডিমগুলো লন্ডন পৌঁছে যাবে। আমাদের প্রত্যাশা, সেপ্টেম্বর মাসে চামচঠুঁটো-বাটানের পরিযায়ন শুরু হওয়ার আগেই ইনকিউবেটরের ২০টি ছানা চুকট্কায় মুক্ত করা যাবে।
লেখকঃ স্বাধীন  বন্যপ্রাণী জীববিজ্ঞানী এবং আলকচিত্রী। বাংলাদেশ সহ বিশ্বজুড়ে হুমকির মুখে থাকা প্রাণী প্রজাতি বিশেষ করে পাখি নিয়ে তিনি কাজ করে থাকেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics