চালে বিষাক্ত ক্যাডমিয়ামের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি নিশ্চিত;
দেশের কৃষি, কৃষক, খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির হুমকীর আশংকায়
রাযীন আশরাফ
বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। বাংলাদেশে মোট আবাদি জমির শতকরা প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ ভাগেই ধানের চাষ হয়ে থাকে। আর কৃষকদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৯২ জনই ধান চাষের সাথে জড়িত। এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই আসে চাল তথা ভাত থেকে। আমাদের প্রান শক্তির উৎস ভাত।
সম্প্রতি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে উৎপাদিত চালে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ ক্যাডমিয়াম উচ্চমাত্রায় পাওয়া গেছে যা স্বাস্থের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির(এসিএস) এক গবেষণায় বিশ্বের ১২ টি দেশের উৎপাদিত চালে উচ্চমাত্রার ক্যাডমিয়াম সনাক্ত হয়েছে। ভয়ংকর হলেও সত্যি যার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের এ গবেষণার সাথে একমত বাংলাদেশ্র বিশেষজ্ঞরাও। তবে তারা বলছেন, সব স্থানে নয়, বিশেষ কয়েকটি জোনে উৎপাদিত চালে ক্যাডমিয়াম রয়েছে। নিম্নমানের সার ব্যবহার এবং শিল্পবর্জ্যই চালে ক্যাডমিয়াম বিষাক্ততার মূল কারন হিসেবে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, ক্যডমিয়াম বিষক্রিয়ায় ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং কিডনি জটিলতার মত প্রানঘাতী রোগ দেখা দিতে পারে। আমেরিকান সোসাইটির(এপিএস) গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের চালে প্রতি কেজিতে ক্যাডমিয়ামের পরিমান ০.০১ থেকে ০.৩ পিপিএম পর্যন্ত এবং এর পরিমান প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।
কানাডিয়ান ফুড ইন্সপেকশন এজেন্সী(সিএফাইএ) সম্প্রতি সে দেশে চালে ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি ০.০০৫৪ থেকে ০.০৫০৫ পিপিএম পেয়েছে যা তারা নিরাপদ বলে জানিয়েছে। এসিএসের গবেষণায় দেখা যায়, চালে ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরের অবস্থান শ্রীলঙ্কার। এছাড়া কম্বোডিয়া, ঘানা, ভারত, ইতালি, জাপান, নেপাল, স্পেন, থাইল্যান্ড, যক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সেও চালে ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে এসিএস।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ ইন্সটিটিউটের (এসারডিআই) উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির সিরাজীর এক প্রতিবেদনে দেওয়া এক বিবৃতি অনুযায়ী, বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চল এলাকার ধানি জমিতে ক্যাডমিয়ামের পরিমান বাড়ায় তা চালে চলে আসছে। এতে উল্লেখ করা হয়,” চালে ক্যাডমিয়ামের প্রধাণ কারণ জমিতে নিম্নমানের টিএসপি সার প্রয়োগ এবং গার্মেন্টস, ওষুধ কারখানা, টেক্সটাইল, ট্যানারির অপরিশোধিত বর্জ্য পানিতে মিশে তা নদীসহ জলাশয়ের পানিতে ক্যাডমিয়ামের পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছে। উক্ত পানি জমিতে আসায় তা গাছের মধ্য দিয়ে চালে চলে আসছে।
তবে বাংলাদেশের সব অঞ্চলের চালে ক্যাডমিয়াম উচ্চ মাত্রায় নেই বলে আরেক প্রতিবেদনে দাবি করেছেন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ বাকী। তার মতে, ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের লালমাটিতে ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি রয়েছে। এছাড়া শিল্পাঞ্চল এলাকার বিশেষ করে ট্যানারি শিল্পের বর্জ্য ব্যবহারের ফলে চালে অতিরিক্ত মাত্রায় ক্যাডমিয়াম প্রবেশ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণার বিষয়ে এই অধ্যাপক বলেন, তারা (আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি) সম্ভবত যথেচ্ছ পদ্ধতিতে নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা করেছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, বেলে মাটি ও উত্তরাঞ্চলের জমিতে এখনো ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি নেই।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, গত বছর তারা সারা দেশ থেকে সারের নমুনা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে ডিলারের মাধ্যমে বিক্রি হওয়া ৫০ শতাংশ সারে ভেজাল রায়েছে। পরীক্ষায় ভেজাল জিংক সালফেট ও জি্পসাম সারের মধ্যে মানবদেহের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকারক ক্যাডমিয়ামসহ অন্যান্য ধাতব পদার্থও পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। মানবদেহে ক্যাডমিয়ামের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে এক বিবৃতিতে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল বাকী বলেন, ” মানব শরীরে অতিরিক্ত ক্যাডমিয়াম জমা হলে মারাত্নক বিষক্রিয়ায় ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং কিডনির রোগ দেখা দিতে পারে।”যেসব অঞ্চলের আবাদী জমিতে ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি রয়েছে তা কমিয়ে আনতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্র তার পরামর্শ, সকল ভারী ধাতু অপসারনে ‘ফাইটোরেমিডেশন’ প্রক্রিয়া অনুসরন করা উচিত। এই প্রক্রিয়ায় আগাছা জাতীয় উদ্ভিদ চাষের মাধ্যমে জমি থেকে ক্ষতিকর ভারী ধাতু অপসারন করা হয়। এছাড়াও সারের ‘বিশুদ্ধতা বিশ্লেষণ’ এর মাধ্যমে তাতে ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি যাচাই করে এরপরই জমিতে তা প্র্য়োগের পরামর্শ দেন কৃষি বিজ্ঞানের এই অধ্যাপক। তিনি আরো জানান, এসব তথ্য মোটেই পূর্ণাঙ্গ নয়, কারণ দেশের মাটিতে উৎপাদিত চালে ক্যাডমিয়ামের মাত্রা নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে দেশব্যাপী কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এত দিন মাছ, ফলমুল ইত্যাদিতে ক্ষতিকারক রাসায়নিক মেশানো বা খাদ্যদ্রব্যে ক্ষতিকারক ভেজাল মেশানো নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন থাকলেও প্রধান খাদ্যদ্রব্য চালে বিষাক্ত ধাতবের উপস্থিতি এবং এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে মোটেই ওয়াকিবহাল ছিলাম না। কিন্তু চালে এখন উচ্চমাত্রায় ক্যাডঁমিয়াম সনাক্ত হওয়ায় দেশি বিদেশি কোনো চালই ভোক্তাদের নিশ্চিন্তে খাওয়ার উপায় থাকছে না। কারন ক্যাডমিয়ামের মাত্রা সনাক্ত করে নিরাপদ চাল বাজার থেকে কেনার সামর্থ্য সাধারন ভোক্তার নেই। কাজেই জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।
উদ্বেগের বিষয় হলো দেশের ধানের জমিতে ক্যাডমিয়ামের মাত্রা বাড়তে থাকলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকীর মুখে পড়বে। এদেশের জনসংখ্যার বড় অংশ কৃষির উপর নির্ভরশীল। আর দেশে উৎপাদিত প্রধান শস্যই হচ্ছে ধান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধান উৎপাদনে আমাদের ধারাবাহিক সাফল্য দেশের খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণতা এনে দিয়েছে। দেশ আজ সীমিত আকারে চাল রপ্তানির কথাও ভাবছে। এই মুহুর্তে দেশে উৎপাদিত ধানের চালে ক্যাডমিয়ামের মত বিষাক্ত ধাতবের উপস্থিতি আসলেই উদ্বেগজনক। এর বিস্তার শুধু কৃষিকে বিপর্যস্ত করে না এমনকি ভেঙে দিতে পারে কৃষি নির্ভর অর্থনীতি। তাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করতে হবে, দেশের কোন কোন এলাকার চালে ক্যাডমিয়াম অনিরাপদ মত্রায় আছে তা শনাক্ত করতে হবে; কারণ অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। জমিতে ক্যাডমিয়ামেরমাত্রা বৃদ্ধির চিহ্নিত কারন যেমন-ক্যাডমিয়ামযুক্ত সা্র, অপরিশোধিত শিল্প বর্জ্যের বিস্তার রোধ করতে হবে। সচেতন করতে হবে কৃষকদের, আর সতর্ক হতে হবে চাল আমদানির ক্ষেত্রেও। ভোক্তাদের নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে। কাজেই সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে দ্রুত তৎপর হওয়া এৎকান্ত আবশ্যক, তা না হলে দেশ, দেশের কৃষক, অর্থনীতি সব কিছু ব্যাপক আকারে বিপর্যস্ত হয়ে পরবে।
তথ্য সূত্র- কৃষি তথ্য সার্ভিস
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো