কৃষককে রাতে ঘুমাতে দিন
দিনাজপুর শহর থেকে রওনা হয়েছি ফুলবাড়ীর পথে। সেখান থেকে নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনে করে ঢাকায় যাব। মধ্যরাতের ট্রেন বলে রওনা হয়েছি রাত করে। মাইক্রোবাসে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ইনস্টিটিউটের নেতারা। আমরা ফিরছি দিনাজপুরে কর্মসংস্থানসংক্রান্ত একটি সেমিনার শেষে। রাত গভীর বলে পথের পাশের কোনো বাড়িতে আলো দেখতে পাওয়ার কথা নয়। দেখাও যাচ্ছিল না। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখছিলাম যখন দুই পাশে বিস্তীর্ণ ধানখেত দেখা যাচ্ছিল। কিছুদূর পর পর আলো। দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে জোনাকবাতি। তবে এগুলো জোনাকবাতি নয়, সেচের বাতি। খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছিল, কিছু মানুষের আনাগোনা!
একটি টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়েছে আমাদের সবার। ঘণ্টা বাজিয়ে কৃষকপুত্র ঘোষণা করছে, বাবা, রাত এগারোটা বেজেছে। মাঠে যাওয়ার সময় হলো!
হ্যাঁ। যাঁরা আমাদের খাওয়ানোর জন্য পরিশ্রম করেন, সেই কৃষককে রাত এগারোটা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত আমরা মাঠে পাঠিয়ে দিই। বলি, সেই সময়ে আমরা যাঁরা শাদা ‘শাদা কলারের’ শ্রমিক, তাঁদের কোনো কাজ থাকে না; তখন আমাদের ঘুমানোর আর বিশ্রাম নেওয়ার সময়। আর যাঁরা আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের তখন রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে মাঠে থাকতে হয়। সঙ্গে তাঁর শিশুপুত্রটিও থাকে। এই অমানবিকতা আমরা কেবল কৃষকের সঙ্গে করছি, তা নয়, দেশের প্রধান আয়ের যে তিনটি খাত, যথাক্রমে গার্মেন্টস কর্মী, অভিবাসী আর কৃষক—প্রত্যেকের সঙ্গে করছি।
আমাদের দেশে বোরো মৌসুমে সেচকাজের জন্য দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লাগে। এর মধ্যে অর্ধেক হলো পানিকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঠেলে দেওয়ার জন্য বা কম গভীরতা থেকে পানি তোলার জন্য। যেমন: খাল, নদী বা নালা থেকে পানি তোলা; আর বাকিটা লাগে মাটির নিচ থেকে পানি তোলার জন্য। এ সময় সবাইকে মাঠে থাকতে হয়, না হলে নিজের হিস্যা ঠিকমতো পাওয়া যায় না। তার মানে, প্রতিবছর আমাদের কৃষকদের একটি বড় অংশকে বোরো মৌসুমে রাতে মাঠে থাকতে হয়। ভাবা যায়!
ইচ্ছে করলে কি এই সমস্যার সমাধান করা যায় না?
আমার মনে হয় যায়। একটি চিন্তা হলো দিনের বেলায় কৃষককে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ দেওয়া। এটি এখন একটি কঠিন বিষয় বলে অনেকেই আমার এই প্রস্তাব উড়িয়ে দেবেন। তবে, এটি হবে চূড়ান্ত সমাধান।
তার আগে আমরা বিকল্প কিছু বিষয়ও ভাবতে পারি। যেমন সৌরশক্তি। সনাতনি চিন্তার যে সোলার পাম্প সেটা হলো সৌর প্যানেল, ইনভার্টার (ডিসিকে এসি করার জন্য) ও ব্যাটারি (শক্তি সঞ্চয় করার জন্য) তারপর মোটর আর পাম্প। সৌরবিদ্যুৎ মানেই অনেক খরচ। এখনো এক ওয়াট তৈরিতে এক ডলারের বেশি খরচ পড়ে। তারপর সেটাকে কনভার্ট করো রে, ব্যাটারিতে রাখো রে ইত্যাদি!
এই সৌরবিদ্যুৎকে একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করেই আমাদের দুটি সমস্যার সমাধান হয়তো সম্ভব। একটি হলো কৃষককে রাতে মাঠে থাকতে হবে না। দিনের বেলায় তাঁর সেচের কাজ হবে। আর সোলার পাম্পটি কেবল সেচের কাজে ব্যবহার করা হবে। যদি কেবল সেচের কাজে ব্যবহার করা হয়, তাহলে ব্যাটারির দরকার লাগে না। যদি বৃষ্টির জন্য পাম্প চালানো না যায়, তাহলেও সমস্যা নেই। কারণ, আমি তো পানিই তুলব। বৃষ্টি হলে তো সেটা পাবই! আর যদি পাম্পের মোটরটা ডিসি মোটর হয়, তাহলে আর ইনভার্টারের প্রয়োজন হয় না।
বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুৎফুল কবীর ঠিক এই কাজটিই পরীক্ষা করে দেখালেন। তিনি একটা বুদ্ধি করলেন, সিরিজ ডিসি মোটর; মানে রোদ বেশি থাকলে সব চলবে আর কম থাকলে একটি বা দুটি। বুয়েটের ছাদে প্রথম শুরু হলো। তবে, কয়েক দিনের মধ্যে বোঝা গেল, একটি সিস্টেমেটিক গবেষণা করতে পারলে এটিকে কাজে পরিণত করা সম্ভব। পরে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হলো একটি গবেষণা—ডিসি মোটর পাম্পের অ্যাসেম্বলি করা, নানা আকারের মোটর পাম্প নিয়ে টেস্ট করা এবং এসব শেষ করে মাঠে পরীক্ষা। কেরানীগঞ্জের বামুনশুর মৌজার এক সম্পন্ন গৃহস্থ রাজি হলেন তাঁর ১০ বিঘা জমিতে এই পাম্প দিয়ে সেচকাজের। বোরো মৌসুমে বসানো হলো পাম্প। পানি উঠে এল ২০ ফুট গভীরে। একটি দেড় ইঞ্চি, একটি দুই ইঞ্চি, আরেকটি তিন ইঞ্চি পাম্প দিয়ে শুরু হলো সেচকাজ। দেখা গেল, সকালে ছোট পাম্পটি চলতে থাকে। বেলা আর রোদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎপ্রবাহ বাড়ে আর চালু হয় বাকি দুটি। সূর্য যখন মধ্যগগনে থাকে, তখন তিনটি পাম্পই চলতে থাকে। সেখানে এক দিনে সবচেয়ে বেশি পানি উঠেছে এক লাখ ২০ হাজার লিটার। তবে, দেড় লাখ লিটার পর্যন্ত তোলা সম্ভব। বসানো হয়েছিল দুই হাজার ওয়াট মোট ক্যাপাসিটির ১২টি প্যানেল।
এই পাইলট প্রকল্প সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে দুই বছর হলো। তবে এটিকে মাঠে নেওয়ার বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি, সরকারি বা বেসরকারি কোনো পর্যায়েই। বুয়েট গবেষণায় এর সাফল্য প্রমাণিত হলেও এটি নিয়ে তেমন আওয়াজ নেই। সৌরশক্তির উদ্ভাবনী ব্যবহারের মাধ্যমে সেচসমস্যার আরও কিছু ভালো সমাধান বের করা সম্ভব।
আমাদের কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে মাঠের কৃষির তেমন সংযোগ নেই। অনেকেই ভাবেন, কৃষি আর কৃষক নিয়ে কাজ করবে কেবল চারটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ এখন সময় হয়েছে কৃষির আধুনিকায়নের। চীনের মতো দেশের কৃষিতে এগিয়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ, এই খাতে বিজ্ঞাননির্ভর গবেষণা ও উন্নয়ন। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কৃষি আর কৃষকের ওতপ্রোত সম্পর্ক।
আমরা বরং কৃষি আর কৃষককে দূরে সরিয়ে রাখতে পছন্দ করি। আমরা ভাবি, কৃষক রাতে থাকবেন মাঠে। দিনের বেলা করবেন হালচাষ। আর ভদ্রলোকেরা তাঁদের নানাভাবে হেয় করবেন।
আর কতকাল চলবে এসব?
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।
http://www.prothom-alo.com