কালেঙ্গায় বিরল গোলাপি শালিক
আ ন ম আমিনুর রহমান
রেমা কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে বেড়ানোর ইচ্ছা অনেক দিনের হলেও উপযুক্ত সঙ্গী-সাথির অভাবে কখনোই যাওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত আটজনের একটা দল নিয়ে গত মার্চের এক রাতে ঢাকা থেকে রওনা হই। ভোরে পৌঁছে সারাটা দিন কালেঙ্গা বিটে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন পাখি, প্রাণী ও প্রজাপতির ছবি তুললাম। পরদিন কালেঙ্গা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার হেঁটে রেমা যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। উদ্দেশ্য বন্য প্রাণী ও পাখি দেখতে দেখতে ও ছবি তুলতে তুলতে যাওয়া।
ফুলঝুরি, টুনটুনি, গোলাপি সহেলি, সিপাহি বুলবুল, পাহাড়ি ময়না, লাল-বুক টিয়া, কেশরাজ ও শামুকভাঙার ছবি তুলতে তুলতে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যখন ছনবাড়ি বিটের সামনে এসেছি, ঠিক তখন সঙ্গী আলী রেজা উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল—দেখুন, দেখুন, শেওড়াগাছে বিরল এক পাখি বসেছে। দলের আরেক সদস্য মারুফ রাসেল মানতে নারাজ—না, এটা সেই পাখি হতেই পারে না। এগুলো শুধু সেন্ট মার্টিন বা উপকূলীয় এলাকাতেই দেখা গেছে। আমি ক্যামেরার চোখে চোখ রেখে পটাপট দুটো ছবি তুললাম। ছবি বেশি ভালো না হলেও স্পষ্ট বোঝা গেল, রেজার কথাই ঠিক। ভালো ছবি তোলার আশায় যেই না একটু এগিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গেই উড়াল দিল পাখিটি। আফসোস, তর্কাতর্কির কারণে তিনজনের কেউ-ই ভালো ছবি তুলতে পারলাম না।
যাহোক, এ পাখি এখানে আবিষ্কার করব ভাবতেই পারিনি। তবে সকালে আমি গোলাপি সহেলির ছবি তোলার পর আলী রেজা একবার এই বিরল পাখিটির নাম উচ্চারণ করেছিল। কাকতালীয়ভাবে হলেও শেষ পর্যন্ত ওর দেখা পেলাম। তাই পুরো দলটি দারুণ খুশি। কারণ, এখন পর্যন্ত দ্বীপ, উপকূলীয় এলাকা কিংবা সুন্দরবন ছাড়া মূল ভূখণ্ডের গভীরে, যেমন রেমা কালেঙ্গা, লাউয়াছড়া বা অন্যান্য বনে এই পাখি দেখা গেছে বলে শুনিনি। এটি হলো এ দেশের অতি বিরল পরিযায়ী পাখি গোলাপি শালিক বা গোলাপি কাঠশালিক (Rosy Starling)। অনেকে লাল ময়না বলেও ডাকে। বৈজ্ঞানিক নাম Strunus roseus।
গোলাপি শালিক আকারে ভাতশালিক, ঝুঁটি শালিক বা গোশালিকের মতোই ২৩ সেন্টিমিটার লম্বা। আর ওজন প্রায় ৬৪ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। শুধু প্রজনন মৌসুমে পুরুষের দেহের রং কিছুটা উজ্জ্বল হয় ও মাথার ঝুঁটিটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্ত্রীর ঝুঁটি কিছুটা ছোট হয়। প্রাপ্তবয়স্ক গোলাপি শালিকের দেহের গোলাপি রঙের জন্য সহজেই অন্য প্রজাতির শালিক থেকে আলাদা করে চেনা যায়। এদের মাথা, মুখমণ্ডল, ঘাড়, গলা, ডানা ও লেজ চকচকে কালো। পিঠ, বুক, পেট ও তলপেট হালকা গোলাপি। ঠোঁট, পা ও নখ ফ্যাকাশে কমলা।
এরা পারিবারিক বা বড় দলে কৃষিজমি, স্যাঁতসেঁতে তৃণভূমি, ফুল-ফলের বাগান ও কাঁটা ঝোপে বিচরণ করে। অবশ্য আমরা একটিমাত্র শালিককেই গাছের ফল খেতে দেখেছি। এরা পোকামাকড়, ফল, ফুল-ফলের রস, শস্যদানা ইত্যাদি খেতে পছন্দ করে। আর তাই খাবারের খোঁজে চষা জমি, ফুল বা ফলের বাগানের আশপাশে ঘুরে বেড়ায়। এরা পরিষ্কার ও উচ্চ স্বরে চিক্-ইক্-ইক্-ইক্ বা কি-কি-কি স্বরে ডাকে।
গোলাপি শালিক সাধারণত মে থেকে জুন মাসে প্রজনন করে। এদের মূল আবাস এলাকা মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া। উঁচু ও খাড়া পর্বতের গায়ে গর্ত করে বা ফাটলে আমাদের গাঙশালিকের মতো দল বেঁধে বিশাল কলোনি তৈরি করে বাসা বানায়। স্ত্রী শালিক তাতে তিন থেকে পাঁচটি ফিকে নীল রঙের ডিম পাড়ে।
এ দেশে এখনো এই বিরল পাখি সম্পর্কে তথ্যের অপ্রতুলতা রয়েছে। কাজেই এ সম্পর্কে গবেষণা হওয়া দরকার। এই পাখি এ দেশে আরও বেশি সংখ্যায় আসুক ও ভালোভাবে বেঁচে থাকুক—এটাই আমাদের কামনা।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো (২৩/০৬/২০১৩)