কপোতাক্ষ নদ পুন:খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন অনিশ্চিত
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার বুক চিরে প্রবাহিত কপোতাক্ষ নদ পুন:খননে গড়িমসি চলছে। খোজ নিয়ে জানা গেছে, কপোতাক্ষ নদ এ অঞ্চলের অন্যতম একটি বৃহত্তম নদী। এ নদীর প্রকৃতি অন্যান্য নদী থেকে ভিন্ন। প্রায় দেড় শ বছর যাবৎ এ নদের সাথে পদ্মা প্রবাহর কোন সংযোগ নেই। এটি একটি জোয়ার-ভাটার নদী। মূলত জোয়ার-ভাটার প্রবাহের সাথে এ নদীর অস্তিত্ব নির্ভর করে।
বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধ বা বোল্ডার ব্যবস্থা চালু করার ফলে নদ-নদীর বুকে পলি জমে সাতক্ষীরার ওপর দিয়ে প্রবাহিত কপোতাক্ষ নদসহ দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের নদনদীগুলো ভরাট হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়তে শুরু করে। যার ফলশ্রুতিকে প্রতি বর্ষা মৌসুমে ওইসব নদনদীর উপচে পড়া পানিতে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আশ্রয়হীন হয়ে পড়া কয়েক লাখ মানুষের আশ্রয় নিতে হয় উঁচু রাস্তা অথবা আশ্রয়কেন্দ্রে।
তালা ও কলারোয়ার ওপর দিয়ে প্রবাহিত কপোতাক্ষ নদের দুই তীরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে স্রোতহীনা কপোতাক্ষের বুক পার্শ্ববর্তী মাঠ অপেক্ষা উঁচু হওয়ায় গত ২০০০ সালের ভয়াবহ বন্যার পর থেকে বছরের ছয় থেকে সাত মাস তাদের জলাবদ্ধতার মধ্যে দিন কাটাতে হয়। নদী খননের জন্য সরকার টাকা বরাদ্দ করলেও তার মোটা অংশ চলে যায় রাজনৈতিক নেতা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের পকেটে। ২০০৯ সালের বন্যায়ও মানুষ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘ সাত মাস জলাবদ্ধতার ফলে মানুষ মারা গেলে অন্য জেলায় নিয়ে যেয়ে লাশের সৎকার করতে হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা ব্যয়ে চার বছর মেয়াদী “কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়)” অনুমোদন করেন। পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের অধীনে এ প্রকল্পটির মূল কাজ তালা উপজেলার জালালপুর ও খেসরা ইউনিয়নের পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার (বিলের মধ্যে জোয়ার-ভাটার ব্যবস্থা) বাস্তবায়ন ও ৯০ কিলোমিটার কপোতাক্ষ নদ খনন। চার বছর মেয়াদি প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত। প্রকল্পের ডিজাইন অনুযায়ী পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার চালুর পর নদী খনন কার্যক্রম শুরুর কথা উল্লেখ হয়েছে।
যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পাখিমারা বিলের জন্য প্রস্তাবিত কাজসমূহ হলো:
(১) বিলের চারিপাশে ১০ দশমিক ২০ কিলোমিটার পেরিফেরিয়াল বাঁধ নির্মাণ
(২) পেরিফেরিয়াল বাঁধে ২২টি আউটলেট পাইপ নির্মাণ,
(৩) ড্রেজার দ্বারা এক দশমিক ৫০ কিলোমিটার সংযোগ চ্যানেল খনন,
(৪) সংযোগ চ্যানেল খননের জন্য ৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ,
(৫) সংযোগ খালের এক কিলোমিটার তীর সংরক্ষণ,
(৬) সংযোগ খালের ওপর একটি বেইলি ব্রিজ নির্মাণ এবং
(৭) যথাযথ মূল্যে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান।
গ্রামবাসী জানায়, পাখিমারা বিলে আগামি জুন মাসের মধ্যে জোয়ারাধার কার্যক্রম বাস্তবায়নের কথা থাকলেও অদ্যাবধি তা শুরু হয়নি। দ্বিতীয় বছরের ছাড়কৃত একটি টাকাও খরচ করা হয়নি। প্রকল্পের প্রথম বছর বিশেষ করে জোয়ারাধার চালুর জন্য ব্যয় বরাদ্দের ২৮ কোটি টাকার মধ্যে ১৩ কোট টাকা ছাড় করা হয়। এ টাকার মধ্য থেকে পাখিমারা বিলে পেরিফেরিয়াল বাঁধের ৮০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। যদিও বাঁধের উচ্চতা ও বাঁধ কতটা টেকসই হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে বরাদ্দকৃত ১১৪ কোটি টাকার মধ্যে ১৫ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। যদিও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের গড়িমসি ও উদ্যোগহীনতার কারণে ওই টাকা থেকে একটি টাকাও চলতি বছর প্রকল্পের জন্য খরচ করা হয়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজন জমির মালিক জানান, জোয়ারাধার কার্যক্রম বাস্তবায়নে অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি মতবিনিময়ের মাধ্যমে তালিকা তৈরি করে প্রায় দুই হাজার একর জমির মালিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ছিল। ক্ষতিপূরণ বাস্তবায়নে এ পর্যন্ত কোন উদ্যোগ না নেওয়ায় চাপা ক্ষোভ রয়েছে তাদের মধ্যে। ফলে আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে প্রকল্প বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
কয়েকজন নদী বিশেষজ্ঞ জানান, সুবিধাজনক বিলের মধ্যে জোয়ার-ভাটা বাস্তবায়ন ছাড়া জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও নদী ভরাট বন্ধ করা সম্ভব নয়। বিলে জোয়ারাধার নির্মাণ একটি কৃত্রিম ব্যবস্থা। জোয়ারের পানির সঙ্গে মিশ্রিত পলি জমে বিল উঁচু হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় নদীর মধ্যে পলি জমতে না পারায় নদীর নাব্যতা অব্যাহত থাকে। বহুল আলোচিত বিল ডাকাতিয়া ও ভবদহ এলাকায় এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জোয়ার-ভাটার নদীগুলোর নাব্যতা রক্ষায় ও জলাবদ্ধতা নিরসনে জোয়ারাধার (টিআরএম) পদ্ধতির কোন বিকল্প নেই।
তারা আরো জানান, চলতি বছর যদি কপোতাক্ষ অববাহিকার পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার চালু না হয় তাহলে বর্ধিত হারে পলি জমে কপোতাক্ষ নদের অকাল মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়বে এবং পরবর্তী বছর পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। কপোতাক্ষ নদের বাঁচা-মরার ওপর এ জনপদের প্রায় ১৫ লাখ অধিবাসীর জীবন-জীবিকায় রয়েছে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক। কপোতাক্ষসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জোয়ার ভাটার ১১টি নদী দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কপোতাক্ষ, শালিখা, বেতনা, মরিচ্চাপ, লাবন্যবতি, সাপমারা, আপার ভদ্রা, হরি, হামকুড়া, শৈলমারী ও সালতা নদী একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। নদীগুলোর সঙ্গে সাতক্ষীরা, খুলনা ও যশোর জেলার প্রায় ৫০ লাখ মানুষের ভাগ্য জড়িত। বিগত এক দশক ধরে জলাবদ্ধতার কারণে কপোতাক্ষসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ বসবাসের জন্য পেশা পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। কপোতাক্ষের পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলে এ এলাকা নিঃসন্দেহে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। তখন ব্যাপকভাবে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া মানুষের আর কোন উপায় থাকবে না। এ মানবিক বিপর্যয় থেকে মানুষজনকে বাঁচাতে চলতি মৌসুমে যে কোন মূল্যে পাখিমারা বিলে টিআরএম বাস্তবায়ন করতে হবে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, টিআরএমভুক্ত জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা ইতিমধ্যে চলে এসেছে। খুব দ্রুত তা প্রদান করা হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী পানি উন্নয়ন বোর্ডের যশোর ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মশিউর রহমান বলেন, টিআরএমভুক্ত জমির মালিকদের বিঘাপ্রতি ১৩ হাজার টাকারও বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ জন্য জমির মালিকদের শিগগিরই নোটিশ পাঠানো হবে এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান শুরু হওয়ার পর অবকাঠামোগত অন্যান্য কাজ করা হবে। তিনি আরও বলেন, চলতি বছর পাখিমারা বিলে টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলে আগামী বছর কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, টিআরএম আওতাভুক্ত জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
স্থানীয় (তালা-কলারোয়া) সাংসদ প্রকৌশলী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, দ্রুত কপোতাক্ষ নদ খনন করে জনগণের দুঃখ লাঘব করা হবে।
প্রসঙ্গত; গত ২০০৮ সালের জাতীর সংসদ নির্বাচনকালীন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের জোরালো দাবির প্রেক্ষিতে কপোতাক্ষ নদের সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন যে, তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কপোতাক্ষ নদের সমস্যা সমাধানকল্পে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সেই অনুসারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা ব্যয় সাপেক্ষে “কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়)” অনুমোদন করেন। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই প্রকল্পটির মূল কাজ তালা উপজেলার জালালপুর ও খেসরা ইউনিয়নের পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার (বিলের মধ্যে জোয়ার-ভাটার ব্যবস্থা) বাস্তবায়ন এবং ৯০ কি. মি. কপোতাক্ষ নদ খনন। চার বছর মেয়াদী প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাল ধরা হয়েছে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত।
সূত্রঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ (২১/০৫/২০১৩)