ওয়ারশ সম্মেলন:একটি পর্যালোচনা

কামরুল ইসলাম চৌধুরী

ওয়ারশ’ জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ুতাড়িত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা চালু হলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু দূত টড স্টার্ন, যুক্তরাজ্যের জলবায়ু প্রতিনিধি বেন লিওন আর ফরাসী জলবায়ু প্রতিনিধি পল তাদের কথা রেখেছেন। স্বল্পোন্নত আর দ্বীপ রাষ্ট্রসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থে ছাড় দিয়েছেন। কয়েক দফা তাদের সঙ্গে কথা হয়। তারা সে কথা রেখেছেন। মন্ত্রী পর্যায়ে লাগাদার নানা দর কষাকষির পর অবশেষে খানিকটা আলোর দেখা মিললো পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ’তে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে। জলবায়ু বিষয়ক ১৯তম সম্মেলনের একেবারে শেষ মুহূর্তে গত ২৩ নভেম্বর অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মন্ত্রী ও প্রতিনিধিরা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি মোকাবেলায় একটি সমঝোতায় উপনীত হয়েছেন। cop19 warsaw

সম্মেলনের শেষভাগে আলোচনায় টানা ৩০ ঘণ্টার অচলাবস্থার পর বিবদমান পক্ষগুলো একটি নয়া বিশ্ব জলবায়ু চুক্তির পথনির্দেশ অনুমোদন করে। এর আগে এই পথনির্দেশ প্রশ্নে সম্মেলন একদিন বেড়ে ২৩ নভেম্বর রাত পর্যন্ত গড়ায়। পথ নক্শার মূল বিষয়গুলো নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে এই বাড়তি সময়ে জোর চেষ্টা চালান মন্ত্রী ও প্রতিনিধিরা। ১৯৯৭ সালে প্রণীত কিয়োটো প্রটোকলের পর বহু কাঙ্ক্ষিত নতুন এই চুক্তি ২০১৫ সালে রাজধানী ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠেয় ২১তম সম্মেলনে সইয়ের কথা রয়েছে। সম্মেলন যখন প্রায় ভেস্তে যাওয়ার মুহূর্তে যেতে বসে তখন সম্মেলনের সভাপতি পোল্যান্ডের পরিবেশ মন্ত্রী মারসিন করোলেক সম্মেলনে যোগ দেয়া মন্ত্রী ও প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলেন, ‘ওয়ারশে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি (খসড়া প্রণয়ন) গ্রহণ এবং চূড়ান্ত না করার পরিণতি সম্পর্কে সতর্কভাবে বিবেচনার জন্য আমি আপনাদের অনুরোধ করছি।’ তিনি বলেন, সংশ্লি¬ষ্ট পক্ষগুলোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হবে না। সভাপতির সেই আহ্বানের পর সম্মেলনে অগ্রগতি না হওয়ায় বাংলাদেশসহ আমরা কিছু উন্নয়নশীল রাষ্ট্র অসন্তুষ্টির কথা তুলে ধরি। জলবায়ু সনদের মূল শব্দগুচ্ছ ‘আল্টিমেট অবজেকটিভ’ থেকে আল্টিমেট খসড়ায় বাদ দেয়ার উদ্যোগের বিরোধিতা করে বলি, গত ২১ বছর ধরে আমরা জাতিসংঘ জলবায়ু সনদ আলোচনায় হাজার হাজারবার এ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছি। তাপমাত্রা দুই থেকে দেড় ডিগ্রির নিচে নামিয়ে আনার জরুরি বার্তা বারবার দিয়েছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কিছু কিছু দায়ী দেশের কারণে আমাদের মতো জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হারিকেন, সিডর, আইলা, মহাসেন, টাইফুন হাইয়ান বিধ্বস্ত দেশগুলো বারবার মার খেয়েই যাবে। এই অসম যুদ্ধে আমরা হেরে যাচ্ছি। ‘আবারও আমাদের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটল। আমরা শোকাহত। চার্লস ডিফেন্সের এ টেল অব টু সিটিজ এর প্রথম বাক্য দু’টির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছি ‘এ ছিল আমাদের সবচে’ খারাপ সময়, এ ছিল আমাদের সবচে’ সুসময়। আসুন, এ খারাপ সময় কাটিয়ে একে সুসময় বানাই।’ এদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিরা এবং চীন বলেছে, তারা সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ‘নিরুত্সাহিত’। জবাবে ইউরোপ বলেছে, প্যারিসের পথে খসড়াটি একটি ‘সূক্ষ্ম মীমাংসা’।

অর্থনৈতিক বিষয়ে অর্থবহ তেমন কিছুই আসেনি। সম্মেলনে আসা দেশগুলো সমস্যার তীব্রতা হরাসে এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গরিব দেশগুলোর সাহায্যে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তাও ধনী দেশগুলো দেবে বলে তারা আশা করা যাচ্ছে না। বৈশ্বিক উষ্ণতার হার নিজ নিজ অবস্থান থেকে গড়ে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মূলত ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর এই লক্ষ্য পূরণে আগামী ২০১৫ সালে অনুষ্ঠেয় প্যারিস সম্মেলনে চুক্তি সইয়ের কথাও রয়েছে। এ চুক্তি সইয়ের পর ২০২০ সালের মধ্যে তা কার্যকরও হওয়ার কথা।

ধনী ও দরিদ্র দেশগুলো কী পরিমাণ কার্বন নির্গমন কমাবে এবং জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে তহবিল সরবরাহ প্রশ্নে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশের প্রতিনিধিরা শুরু থেকেই তর্কে জড়ান। ৭৭-জাতি গোষ্ঠী ও চীনের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবি, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মাধ্যমে পরিবেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে, অতএব তাদেরই সবচেয়ে বেশি হালে কার্বন নির্গমন কমাতে হবে। অন্যদিকে পশ্চিমাদের যুক্তি, চীন ও ভারতের মতো দ্রুত উদীয়মান দেশগুলো পরিবেশের ক্ষতি করছে বেশি। অতএব কার্বন নির্গমন হরাসেও তাদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। অন্যদিকে তহবিল সরবরাহের বিষয়টিও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত মোটা দাগে এবারও বড় কোন অগ্রগতি অর্জিত না হলেও ওয়ারশ সম্মেলনে কিছু সাফল্যও এসেছে। ক্রান্তীয় বনাঞ্চল রক্ষা সংক্রান্ত একটি নতুন আইনে সম্মত হয়েছে সব পক্ষই। পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণে এই বনাঞ্চলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া গাছ পচে গেলে কিংবা কেটে ফেললেও পরিবেশে কার্বন নির্গমন হয়। ২০১৫ সালের সম্ভাব্য জলবায়ু চুক্তির কয়েকটি বিষয়ে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর ঐকমত্য হয়েছে। ১১ নভেম্বর এ সম্মেলন শুরু হয়। এতে ১৯৪টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। সম্মেলনে ক্ষতিকর কার্বন নির্গমনের দায়ভার গ্রহণ নিয়ে ধনী এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে মতানৈক্যের কারণে কোন চুক্তিতে পৌঁছতে পারেনি জাতিসংঘের সমঝোতাকারীরা। ইয়েব সানের আহ্বানের সময় সম্মেলনস্থলে যে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়, জাপানের ঘোষণায় পরক্ষণেই তাতে ছেদ পড়ে। দেশটির প্রতিনিধি সাফ জানিয়ে দেন, ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তৈরি হওয়া সংকট নিরসনে অর্থনৈতিক সমাধান কী করে হবে, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট অঙ্গীকার না থাকায় অসন্তুষ্টি আর ক্ষোভ প্রকাশ করেছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। বলা হচ্ছে, পরিকল্পনাগুলোর অর্থায়ন কীভাবে হবে, গরিব বা উন্নয়নশীল দেশের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা কী রকম হবে, এ বিষয়ে যাবতীয় কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে ২০১৫ সালের আগেই। এ বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ক্লাইমেট কমিশনার কনি হেডেগার্ড বলেন, ‘এসব সম্পন্ন করতে শুধু উন্নত দেশগুলোই নয়, পৃথিবীর সব দেশকেই স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে হবে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে।’ কানি সম্মেলনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। কয়েক দফা আমার সঙ্গেও কথা বলেন। পথ নক্শার কতিপয় দিক : প্রতিনিধিরা এই মৌলিক নীতির পুনর্নিশ্চয়তা দিয়েছেন, ২০১৫ সালে যে জলবায়ু চুক্তি হবে, সেটি জাতিসংঘের ১৯৫টি সদস্য দেশের ‘সবার জন্য গ্রহণযোগ্য’ হবে। চুক্তিতে ধনী-দরিদ্র দেশের মধ্যে কোনো বৈষম্য করা হবে না। এটি হবে পূর্ববর্তী কিয়োটো প্রটোকলের চেয়ে উন্নততর। গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন হরাসে ব্যবস্থা গ্রহণে ইচ্ছুক দেশগুলোকে ওই চুক্তি সইয়ের ‘যথেষ্ট আগেই’ নিজ নিজ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণপূর্বক তা জানাতে হবে। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে অবশ্যই ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসের মধ্যে ঘোষণা দিতে হবে। আগামী বছর পেরুর লিমায় জলবায়ু-সংক্রান্ত দ্বিতীয় দফা আলোচনার আগে চুক্তির সমঝোতামূলক বক্তব্যের একটি খসড়া প্রস্তুত করতে হবে। ২০২০ সাল থেকে নতুন চুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়ন শুরু হবে।

লেখক :জলবায়ু নেগোশিয়েশনে স্বল্পোন্নত ৪৯ দেশের শীর্ষ নেগোশিয়েটর, জাতিসংঘ অভিযোজন কমিটির সদস্য

কৃতজ্ঞতাঃ দৈনিক ইত্তেফাক।২৮/১১/২০১৩

Source : http://www.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMTFfMjhfMTNfMV81XzFfODg5Nzk%3D

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics